পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬১১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পরিচয় । •ሳ ̇ eae আমাদের দেশে বর্তমানকালে, কী বলিয়া আপনার পরিচয় দিব তাহা লইয়া অন্তত ব্ৰাহ্মসমাজে একটা তর্ক উঠিয়াছে। অথচ এ তর্কটা রামমোহন রায়ের মনের মধ্যে একেবারেই ছিল না দেখিতে পাই। এ দিকে তিনি সমাজপ্রচলিত বিশ্বাস ও পূজােৰ্চনা ছাড়িয়াছেন, কোরান পড়িতেছেন, বাইবেল হইতে সত্যধর্মের সারসংগ্ৰহ করিতেছেন, অ্যাডাম সাহেবকে দলে টানিয়া ব্ৰহ্মসভা স্থাপন করিয়াছেন ; সমাজে নিন্দায় কান পাতিবার জো নাই, ঠাঁহাকে সকলেই বিধর্ম বলিয়া গালি দিতেছে, এমনকি, যদি কোনাে নিরাপদ সুযোগ মিলিত তবে তাহাকে মারিয়া ফেলিতে পারে এমন লোকের অভাব ছিল না- কিন্তু কী বলিয়া আপনার | পরিচয় দিব সে বিষয়ে তাহার মনে কোনোদিন লেশমাত্র সংশয় ওঠে নাই। কারণ হাজার হাজার লোকে তঁহাকে অহিন্দু বলিলেও তিনি হিন্দু এ সত্য যখন লোক পাইবার নয়। তখন এ সম্বন্ধে চিন্তা করিয়া সময় নষ্ট করিবার কোনো দরকার ছিল না। : বর্তমানকালে আমরা কেহ কেহ এই লইয়া চিন্তা করিতে আরম্ভ করিয়াছি। আমরা যে কী, সে লইয়া আমাদের মনে একটা সন্দেহ জমিয়াছে। আমরা বলিতেছি আমরা আর কিছু নই, আমরা ব্ৰাহ্ম। কিন্তু সেটা তো একটা নূতন পরিচয় হইল। সে পরিচয়ের শিকড় তো বেশি দূর যায় না। আমি হয়তো কেবলমাত্র গতকল্য ব্ৰাহ্মসমাজে দীক্ষা লইয়া প্রবেশ করিয়াছি। ইহার চেয়ে পুরাতন ও পাকা পরিচয়ের ভিত্তি আমার কিছুই নাই ? অতীতকাল হইতে প্রবাহিত কোনো একটা নিত্য লক্ষণ কি আমার মধ্যে একেবারেই বর্তীয় नाट्रे ? m - এরূপ কখনাে সম্ভবই হইতে পারে না। অতীতকে লোপ করিয়া দিই। এমন সাধ্যই আমার নাই; সুতরাং সেই অতীতের পরিচয় আমার ইচ্ছার উপর লেশমাত্র নির্ভর করিতেছে না । , কথা এই, সেই আমার অতীতের পরিচয়ে আমি হয়তাে গীেরব বােধ করিতে না পারি। সেটা দুঃখের বিষয় । কিন্তু এইরূপ যে-সকল গীেরব পৈতৃক তাহার ভাগ-বাটােয়ারা সম্বন্ধে বিধাতা আমাদের সম্মতি লন না, এই সকল সৃষ্টিকার্যে কোনোরাপ ভোটের প্রথাও নাই। আমরা কেহ বা জার্মািনর সম্রাটবংশে জন্মিয়াছি আবার কাহারও-বা এমন বংশে জন্ম-ইতিহাসের পাতায় সোনালি অক্ষরে বা কালো অক্ষরে যাহার কোনো উল্লেখমাত্র নাই। ইহাকে জন্মান্তরের কর্মফল বলিয়াও কথঞ্চিৎ সাত্মনালাভ করিতে পারি অথবা এ সম্বন্ধে কোনো গভীর তত্ত্বালোচনার চেষ্টা না করিয়া ইহাকে সহজে স্বীকার করিয়া গেলেও বিশেষ কোনো ক্ষতি নাই । অতএব, আমি হিন্দু এ কথা বলিলে যদি নিতান্তই কোনো লজ্জার কারণ থাকে। তবে সে লজ্জা আমাকে নিঃশব্দে হজম করতেই হইবে । কারণ, বিধাতার বিরুদ্ধে নালিশ করিতে হইলে সেই আপিল-আদালতের জজ পাইব কোথায় ? ব্ৰাহ্মসমাজের কেহ কেহ এ সম্বন্ধে এইরূপ তর্ক করেন যে, হিন্দু বলিয়া নিজের পরিচয় দিলে মুসলমানের সঙ্গে আমার যোগ অস্বীকার করা হয়, তাহাতে ঔদার্যের ব্যাঘাত ঘটিয়া থাকে । বস্তুত পরিচয়মাত্রেরই এই অসুবিধা আছে। এমনকি, যদি আমি বলি আমি কিছুই না, তবে যে বলে আমি কিছুই, তাহার সঙ্গে পার্থক্য ঘটে ; হয়তো সেই সূত্রেই তাহার সঙ্গে আমার মারামারি লাঠালাঠি বধিয়া যাইতে পারে । আমি যাহা এবং আমি যাহা নাই এই দুইয়ের মধ্যে একটা বিচ্ছেদ আছে- পরিচয়মাত্রই সেই বিচ্ছেদেরই পরিচয় । 基 এই বিচ্ছেদের মধ্যে হয়তো কোনো একপক্ষের অপ্রিয়তার কারণ আছে। আমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলিয়াই হয়তো কোনো একজন বা একদল লোক আমার প্রতি খড়গহস্ত হইতে পারে। এটা যদি আমি বাঞ্ছনীয় না। মনে করি তবে আমার সাধ্যমত আমার তরফ হইতে অপ্রিয়তার কারণ দূর করিতে চেষ্টা করাই আমার কর্তব্য- যদি এটা কোনো সংগত ও উচিত কারণের উপর নির্ভর না করে, যদি অন্ধসংস্কারমাত্র হয়, তবে আমার নামের সঙ্গে সঙ্গে এই অহেতুক বিদ্বেযটুকুকেও আমার বহন করিতে হইবে। আমি রবীন্দ্রনাথ নাই । বলিয়া শান্তিস্থাপনের প্রয়াসকে কেহই প্রশংসা করিতে পরিবে না। : ইহার উত্তরে তর্ক উঠবে, ওটা তুমি ব্যক্তিবিশেষের কথা বলিলে। নিজের ব্যক্তিগত দায়িত্ব ও অসুবিধা স্বতন্ত্ৰ কথা- কিন্তু একটা বড়ো জাতির বা সম্প্রদায়ের সমন্ত দায় আমার স্বীকৃত নহে সুতরাং যদি, তাহা