পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৪২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

use রবীন্দ্র-রচনাবলী জার্মান শিখিলে আরো ভালো। সেইসঙ্গে এ কথা বলাও বাহুল্য অধিকাংশ বাঙালি ইংরেজি শিখিবে না। সেই লক্ষ লক্ষ বাংলাভাষীদের জন্য বিদ্যার অনশন কিংবা অর্ধসনই ব্যবস্থা, এ কথা কোন মুখে বলা যায়। দেশে বিদ্যাশিক্ষার যে বড়ো কারখানা আছে তার কলের ঢাকার অল্পমাত্র বদল করিতে গেলেই বিস্তর হাতুড়ি-পেটাপেট করিতে হয়- সে খুব শক্ত হাতের কর্ম। আশু মুখুজ্যোমশায় ওরই মধ্যে এক-জায়গায় তিনি যেটুকু করিয়াছেন তার ভিতরকার কথা এই বাঙালির ছেলে ইংরেজি বিদ্যায় যতই পাকা হােক বাংলা না শিখিলে তায় শিক্ষা পুরা হইবে না। কিন্তু এ তো গেল। যারা ইংরেজি জানে তাদেরই বিদ্যাকে চোকাশ করিবার ব্যবস্থা। আর, যারা বাংলা জানে ইংরেজি জানে না, বাংলার বিশ্ববিদ্যালয় কি তাদের মুখে তাকাইবে না ? এতবড়ো অস্বাভাবিক নির্মমতা ভারতবর্ষের বাহিরে আর কোথাও আছে ? আমাকে লোকে বলিবে শুধু কবিত্ব করিলে চলিবে না- একটা প্র্যাকটিক্যাল পরামর্শদাও, অত্যন্ত বেশি আশা করাটা কিছু নয়। অত্যন্ত বেশি আশাচুলোয় যাক, লেশমাত্র আশানা করিয়া অধিকাংশ পরামর্শ দিতে হয়। কিছু করিবার এবং হইবার আগে ক্ষেত্রটাতে দৃষ্টি তো পড়ুক। কোনোমতে মনটা যদি একটু উসখুসি করিয়া ওঠে তা হলেই আপাতত যথেষ্ট । এমনকি, লোকে যদি গালি দেয় এবং মারিতে আসে তা হলেও বুঝি, যে, একটা বেশ উত্তম-মধ্যম ফল পাওয়া গেল। অতএব পরামর্শে নামা যাক । 曾 আজকাল আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা প্ৰশন্ত পরিমণ্ডল তৈরি হইয়া উঠিতেছে। একদিন মোটের উপর ইহা একজামিন-পাসের কুস্তির আখড়া ছিল। এখন আখড়ার বাহিরেও ল্যাঙটটার উপর ভদ্রবেশ ঢাকা দিয়া একটু হাফ ছাড়িবার জায়গা করা হইয়াছে। কিছুদিন হইতে দেখিতেছি বিদেশ হইতে বড়ো বড়ো অধ্যাপকেরা আসিয়া উপদেশ দিতেছেন, এবং আমাদের দেশের মনীষীদেরও এখানে আসন পড়িতেছে। শুনিয়াছি বিশ্ববিদ্যালয়ের এইটুকু ভদ্রতাও আশু মুখুজ্যোমশায়ের কল্যাণে ঘটিয়াছে। আমি এই বলি, বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন বাড়িটার ভিতরের আঙিনায় যেমন চলিতেছে চলুক, কেবল তার এই বাহিরের প্রাঙ্গণটাতে যেখানে আমদরবারের নূতন বৈঠক বসিল সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাটাকে যদি সমস্ত বাঙালির জিনিস করিয়া তোলা যায় তাতে বাধাটা কী ? আহূত যারা তারা ভিতর বাড়িতেই বসুকআর রবাহুত যারা তারা বাহিরে পাত পাড়িয়া বসিয়া যাক-না। তাদের জন্য বিলিতি টেবিল না হয় না রহিল, দিশি কলাপাত মন্দ কী ? তাদের একেবারে দরোয়ান দিয়া ধাক্কা মারিয়া বিদায় করিয়া দিলে কি এ যজ্ঞে কল্যাণ হইবে ? অভিশাপ লাগিবে না কি ? 曝 এমনি করিয়া বাংলার বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি এবং বাংলা ভাষার ধারা যদি গঙ্গাযমুনার মতো মিলিয়া যায়। তবে বাঙালি শিক্ষাধীর পক্ষে এটা একটা তীৰ্থস্থান হইবে। দুই স্রোতের সাদা এবং কালো রেখার বিভাগ থাকিবে বটে কিন্তু তারা একসঙ্গে বহিয়া চলিবে। ইহাতেই দেশের শিক্ষা যথার্থবিস্তীর্ণ হইবে, গভীর হইবে, সত্য হইয়া উঠিবে। শহরে যদি একটিমাত্র বড়ো রাস্তা থাকে তবে সে পথে বিষম ঠেলাঠেলি পড়ে। শহর-সংস্কারের প্রস্তাবের সময় রাস্তা বাড়াইয়া ভিড়কে ভাগ করিয়া দিবার চেষ্টা হয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঝখানে আর-একটি বিদ্যালয়ের কাজে আমার যেটুকু অভিজ্ঞতা তাতে দেখিয়ছি। একদল ছেলে স্বভাবতই ভাবাশিক্ষা অপটু। ইংরেজি ভাষা কায়দা করিতে না পারিয়া যদি বা তারা কোনােমতে এস্ট্রেলের দেউড়িটা তরিয়া যায়- উপরের সিঁড়ি ভাঙিবার বেলাতেই চিৎ হইয়া পড়ে। এমনতরো দুৰ্গতির অনেকগুলা কারণ আছে। এক তো যে-ছেলের মাতৃভাষা বাংলা তার পক্ষে ইংরেজি ভাষার মতো বালাই আর নই। ওযেন বিলিতি তলোয়ারের খাপের মধ্যে দিশি খাড়া ভরিবার ব্যায়াম। তার পরে গোড়ার দিকে ভালো শিক্ষকের কাছে ভালো নিয়মে ইংরেজি শিখিবার সুযোগ অল্প ছেলেরই হয়। গরিবের ছেলের তো হয়ই না । তাই অনেক স্থলেই বিশল্যকরণীর পরিচয় ঘটে না বলিয়া আন্ত গন্ধমাদন বাহিতে হয় ; ভাষা আয়ত্ত হয় না বলিয়া গোটা ইংরেজি বই মুখস্থ করা ছাড়া উপায় থাকে না । অসামান্য