পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দরজা বাহিরের দিকে টানিয়া খুলতে গিয়া যে ব্যক্তি হয়রান হইয়াছে তাকে এটা দেখাইয়া দেওয়া যাইতে পারে যে, দরজা হয় বাহিরের দিকে খোলে, নয় ভিতরের দিকে। দুই দিকেই সমান খোলে এমন দরজা আমাদের দেশে ধনের দরজাটা বহুকাল হইতে এমন করিয়া বানানো যে, সে ভিতরের দিকের ধাক্কাতেই খোলে। আজ তাকে বাহিরের দিকে টান দিবার দরকার হইয়াছে কিন্তু দরকারের খাতিরে কলকবাজা তো একেবারে একদিনেই বদল করা যায় না। সামাজিক মিব্রিটা বুড়ো, কানে কম শোনে, তাকে তাগিদ দিতে গেলেই গরম হইয়া ওঠে। মানুষের শক্তির মধ্যে একটা বাড়তির ভাগ আছে। সেই শক্তি মানুষের নিজের প্রয়োজনের চেয়ে বেশি। জন্তুর শক্তি পরিমিত বলিয়াই তারা কিছু সৃষ্টি করে না, মানুষের শক্তি পরিমিতের বেশি বলিয়াই তারা সেই বাড়তির ভাগ লইয়া আপনার সভ্যতা সৃষ্টি করিতে থাকে। কোনো একটি দেশের সম্বন্ধে বিচার করিতে হইলে এই কথাটি ভাবিয়া দেখিতে হইবে যে, সেখানে মানুষের আপনি বাড়তি অংশ দিয়া কী সৃষ্টি করিয়াছে, অর্থাৎ জাতির ঐশ্বৰ্য আপন বসতির জন্য কোন ইমারত বানাইয়া তুলিতেছে ? ইংলন্ডে দেখিতে পাই সেখানকার মানুষ নিজের প্রয়োজনটুকু সারিয়া বহু যুগ হইতে ব্যয় করিয়া আমাদের দেশের শক্তির অতিরিক্ত অংশ আমরা খরচ করিয়া আসিতেছি। রাষ্ট্ৰতন্ত্রের জন্য নয়, পরিবারতন্ত্রের জন্য। আমাদের শিক্ষাদীক্ষা ধর্মকর্ম এই পরিবারতন্ত্রকে আশ্রয় করিয়া নিজেকে প্রকাশ করিতেছে । আমাদের দেশে এমন অতি অল্পলোেকই আছে যার অধিকাংশ সমর্থ্য প্রতিদিন আপন পরিবারের জন্য ব্যয় করিতে না হয়। উমেদারির দুঃখে ও অপমানে আমাদের তরুণ যুবকদের চােখের গোড়ায় কালি পড়িল, মুখ ফ্যাকাশে হইয়া গেল, কিসের জন্য ? নিজের প্রয়োজনটুকুর জন্য তো নয়। বাপ মা বৃদ্ধ, ভাইকটিকে পড়াইতে হইবে, দুটি বােনের বিবাহ বাকি, বিধবা বােন তার মেয়ে লইয়া তাদের বাড়িতেই থাকে, আর আর যত অনাথ অপোগণ্ডের দল আছে। অন্য কোথাও তাদের আত্মীয় বলিয়া স্বীকার করেই না । এ দিকে জীবনযাত্রার চাল বাড়িয়া গেছে, জিনিসপত্রের দাম বেশি, চাকরির ক্ষেত্ৰ সংকীর্ণ ব্যাবসবুদ্ধির কোনো চৰ্চাই হয় নাই। কাধের জোর কমিল, বোঝার ভার বাড়িল, এই বোঝা দেশের এক প্ৰান্ত হইতে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত । চাপ এত বেশি যে, নিজের ঘাড়ের কথাটা ছাড়া আর-কোনো কথায় পুরা মন দিতে পারা যায় না। উদ্ধৃবৃত্তি করি, লাথিবীটা খাই, কন্যার পিতার গলায় ছুরি দিই, নিজেকে সকল রকমে হীন করিয়া সংসারের দাবি মেটাই । রেলেইস্টিমারে যখন দেশের সামগ্ৰীকে দূরে ছড়াইয়াদিত না, বাহিরের পৃথিবীর সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি একপ্রকার বন্ধ ছিল আমাদের সমাজের ব্যবস্থা তখনকার দিনের। তখন ছিল বীধের ভিতরকার বিধি। এখন शैक्ष उख्रिशाश्, विक्षेि छ७ नोहे । সমাজের দাবি তখন ফলাও ছিল। সে দাবি যে কেবল পরিবারের বৃহৎ পরিধির দ্বারা প্রকাশ পাইত তাহা নহে- পরিবারের ক্রিয়াকর্মেও তার দাবি কম ছিল না । সেই সমস্ত ক্রিয়াকর্মপালপার্বণ আত্মীয় প্রতিবেশী অনাহুত রবাহুত সকলকে লইয়া। তখন জিনিসপত্র সন্তা, চালচলন সাদা, এইজন্য ওজন যেখানে কম আয়তন সেখানে বেশি হইলে অসহ্য হইত না । এ দিকে সময় বদলাইয়াছে কিন্তু সমাজের দাবি আজও খাটাে হয় নাই। তাই জন্মমৃত্যুবিবাহ প্রভৃতি সকল রকম পারিবারিক ঘটনাই সমাজের লোকের পক্ষে বিষম দুর্ভাবনার কারণ হইল। এর উপর এমন উপদেশ দিয়া থাকি পূর্কের মতো সাদাচালে চলিতেইবা দোষ কী ? কিন্তু মানবচরিত্র শুধু উপদেশে চলে না- এ তো বোমযান নয় যে উপদেশের গ্যাসে তার পেট ভরিয়া দিলেই সে উধাও হইয়া চলিবে। দেশকলের টান বিষম টান। যখন দেশেকালে অসন্তোষের উপাদান অল্পছিল, তখন সন্তোষ মানুষের সহজ