পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭১০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Ved NR রবীন্দ্র-রচনাবলী ভিতরে শীত করছিল- তাই একটা কোণের ঘর, যাকে আমরা তোষাখানা বলতুম, যেখানে চাকররা থাকত, সেইখানে গেলুম। আধা-অন্ধকারে জ্যোতিদার চাকর চিন্তে লোহার আঙটািয় কাঠের কয়লা জ্বালিয়ে তার উপরে ঝাঝারি রেখে জ্যৈদার জন্যে রুটি তোস করছে। সেই রুটির উপর মাখন গলার লোভনীয় গন্ধে ঘর ভরা। তার সঙ্গে ছিল চিস্তের গুনগুন রবে মধুকনের গান, আর সেই কাঠেরু আগুন থেকে বড়ো আরামের অল্প-একটুখানি তাত । আমার বয়স বােধ হয় তখন নয় হবে ছিলুম ম্রোতের শ্যাওলার মতাে— সংসারপ্রবাহের উপরতলে হালকাভাবে । ভেসে বেড়াতুম— কোথাও শিকড় পৌঁছয় নি— যেন কারও ছিলুম না, সকাল থেকে রাত্তির পর্যন্ত চাকরদের হাতেই থাকতে হত ; কারও কাছে কিছুমাত্র আদর পাবার আশা ছিল না। জ্যৈদা তখন বিবাহিত, তার জন্যে ভাববার লোক ছিল, তার জন্যে ভোরবেলা থেকেই রুটি-তোস আরম্ভ। আমি ছিলুম সংসারপদ্মার বালুচরের দিকে, অনাদরের কুলে— সেখানে ফুল ছিল না, ফল ছিল না, ফসল ছিল না- কেবল একলা বসে ভাববার মতো আকাশ ছিল । আর, জ্যৈদা পদ্মার যে কুলে ছিলেন সেই কুল ছিল শ্যামল- সেখানকার দূর থেকে কিছু গন্ধ আসত, কিছু গান আসত, সচল জীবনের ছবি একটু-আধটু চোখে পড়ত। বুঝতে পারতুম ওইখানেই জীবনযাত্রা সত্য। কিন্তু পার হয়ে যাবার খেয়া ছিল না— তাই শূন্যতার মাঝখানে বসে কেবলই চেয়ে থাকতুম আকাশের দিকে । ছেলেবেলায় বাস্তব জগৎ থেকে দূরে ছিলুম বলেই তখন থেকে চিরদিন “আমি সুদূরের পিয়াসী । অকারণে ওই ছবিটা অত্যন্ত পরিস্ফুট হয়ে মনে জেগে উঠল।” —পথে ও পথের প্রাস্তে, পত্রসংখ্যা ৩২, ১৪ মার্চ ১৯২৯ বহুদিন পূর্বের একটি চিঠিতেও এই স্মৃতিচিত্রটিই পাওয়া যায় : “দিনযাপনের আজ আর-এক রকম উপায় পরীক্ষা করে দেখা গেছে । আজ বসে বসে ছেলেবেলাকার স্মৃতি এবং তখনকার মনের ভাব খুব স্পষ্ট করে মনে আনবার চেষ্টা করছিলুম। যখন পেনেটির বাগানে ছিলুম, যখন পৈতের নেড়া মাথা নিয়ে প্রথমবার বোলপুরের বাগানে গিয়েছিলুম, যখন পশ্চিমের বারান্দার সবশেষের ঘরে আমাদের ইস্কুলঘর ছিল এবং আমি একটা নীল কাগজের ছেড়া খাতায় বঁাকা লাইন কেটে বড়ো বড়ো কাচা অক্ষরে প্রকৃতির বর্ণনা লিখতুম, যখন তোষাখানার ঘরে শীতকালের সকালে চিন্তা বলে একটা চাকর গুন গুন স্বরে মধুকনের সুরে গান করতে করতে মাখন দিয়ে রুটি তোস করত— তখন আমাদের গায়ে গরম কাপড় ছিল না, একখানা কামিজ পরে সেই আগুনের কাছে বসে শীত নিবারণ করতুম এবং সেই সশব্দবিগলিত নবনীসুগন্ধ রুটিখণ্ডের উপরে লুব্ধদুরাশ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চুপ করে বসে চিন্তার গান শুনতুম— সেই সমস্ত দিনগুলিকে ঠিক বর্তমানের করে দেখছিলুম এবং সেই সমস্ত দিনগুলির সঙ্গে এই রৌদ্রালোকিত পদ্মা এবং পদ্মার চর ভারি এক রকম সুন্দর ভাবে মিশ্রিত হচ্ছিল- ঠিক যেন আমার সেই ছেলেবেলাকার খোলা জানলার ধারে বসে এই পদ্মার একটি দৃশ্যখণ্ড দেখছি বলে মনে হচ্ছিল। -ছিন্নপত্র, ২৭ জুন ১৮৯৪ নর্মাল স্কুলের শিক্ষা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বহু বৎসর পরে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর স্মৃতিতর্পণ উপলক্ষে (২০ অগ্রহায়ণ ১৩৩৮) এভাবে স্মৃতিচারণ করেন : - “সেই যুগে নর্মাল স্কুলে কোনোমতে ছাত্রবৃত্তি ক্লাসের এক ক্লাস নীচে পর্যন্ত আমার উন্নতি হয়েছিল। বংশে ধনমর্যাদা না থাকলে তাও বোধ হয়। ঘটত না । তখন যে ভাষাকে সাধুভাষা বলা হােত অর্থাৎ যে ভাষা ভুল করে আমাদের মাতৃভাষার পাড়ায় পা দিলে গঙ্গাস্নান না করে ঘরে ঢুকতেন না তার সাধনার জন্যে লোহারাম শিরোরত্বের ব্যাকরণ এবং আদ্যনাথ পণ্ডিতমশায়ের সমাসদার্পণ আমাদের অবলম্বন ছিল। আজকের দিনে শুনে সকলের আশ্চৰ্য'