পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৩৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গ্রন্থপরিচয় ዓ Sዓ তোমার ফুলবাগানে যখন চারিদিকেই ফুল ফুটিতেছে, তখন যে তোমাকে দেখিতে পাই না, তাহাতে তেমন আশ্চর্য নাই। কিন্তু যখন দেখি ঘরে ঘরে রোগের মূর্তি তখনো যে রোগীর শিয়রের কাছে তুমি বসিয়া নাই, এ যেন কেমন বিশ্বাস হয় না। উৎসবের সময় তুমি নাই, বিপদের সময় তুমি নাই, রোগের সময় তুমি নাই ! তোমার ঘরে যে প্রতিদিন অতিথি আসিতেছে- হৃদয়ে সরল শ্ৰীতির সহিত তাহাদিগকে কেহ যে আদর করিয়া বসিতে বলে না । তুমি যাহাকে বড়ো ভালোবাসিতে সেই ছোটাে মেয়েটি যে আজ সন্ধ্যাবেলায় আসিয়াছেতাহাকে আদর করিয়া খেতে দিবে কে । এখন আর কে কাহাকে দেখিবে ! যে অযাচিত প্রীতি-মোহ-সান্তনায় সমস্ত সংসার অভিষিক্ত ছিল সে নিঝর শুষ্ক হইয়া গেল- এখন কেবল কতকগুলি স্বতন্ত্র স্বার্থপর কঠিন পাষাণখণ্ড তাহারই পথে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হইয়া রহিল ! যাহারা ভালো, যাহারা ভালোবাসিতে পারে, যাহাদের হৃদয় আছে, সংসারে তাহদের কিসের সুখ ! কিছু না, কিছু না । তাহারা তারের যন্ত্রের মতো, বীণার মতো- তাহাদের প্রত্যেক কোমল স্নায়ু, প্রত্যেক শিরা সংসারের প্রতি আঘাতে বাজিয়া উঠিতেছে । সে গান সকলেই শুনে, শুনিয়াও সকলেই মুগ্ধ হয়- তাহদের বিলাপধ্বনি রাগিণী হইয়া উঠে, শুনিয়া কেহ নিশ্বাস ফেলে না ! তাই যেন হইল, কিন্তু যখন আঘাত আর সহিতে পারে না, যখন তার ছিডিয়া যায়, যখন আর বাজে না, তখন কেন সকলে তাহাকে নিন্দা করে, তখন কেন কেহ বলে না। ‘আহা’ !- তখন কেন তাহাকে সকলে তুচ্ছ করিয়া বাহিরে ফেলিয়া দেয় । হে ঈশ্বর, এমন যন্ত্রটিকে তোমার কাছে লুকাইয়া রাখ না কেন- ইহাকে আজিও সংসারের হাটের মধ্যে ফেলিয়া রাখিয়াছ কেন- তোমার স্বৰ্গলোকের সংগীতের জন্য ইহাকে ডাকিয়া লও- পাষণ্ড নরাধাম পাষাণহৃদয় যে ইচ্ছা সেই ঝন ঝন করিয়া চলিয়া যায়, অকাতরে তার ছিড়িয়া হাসিতে থাকেখেলাচ্ছলে তাহার প্রাণের সংগীত শুনিয়া তার পরে যে যার ঘরে চলিয়া যায়, আর মনে রাখে। না । এ বীণাটিকে তাহারা দেবতার অনুগ্রহ বলিয়া মনে করে না- তাহারা আপনাকেই প্ৰভু বলিয়া জানে— এইজন্য কখনো বা উপহাস করিয়া, কখনাে বা অনাবশ্যক জ্ঞান করিয়া, এই সুমধুর সুকোমল পবিত্রতার উপরে তাঁহাদের কঠিন চরণের আঘাত করে- সংগীত চিরকালের জন্য নীরব হইয়া যায় । —ভারতী, বৈশাখ ১২৯২ এই শোকের ভিতর দিয়া রবীন্দ্রনাথ জীবন ও মৃত্যু উভয়েরই গভীরতর পরিচয় লাভ করিয়াছেন । প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় যথার্থই বলিয়াছেন যে, “মাতা সারদা দেবীর মৃত্যুর পর. তিনিই কাদম্বরীদেবী] মাতৃহীন শিশুদের মাতৃস্থান, বন্ধুস্থান গ্রহণ করিয়াছিলেন।”** প্রসঙ্গক্রমে এখানে ইহাও উল্লেখযোগ্য যে ‘পুষ্পাঞ্জলি’তে যে-শোকবেদনার প্রকাশ দেখা যায়, তাহাঁই বহু বৎসর পরে লিপিকা গ্রন্থের কয়েকটি রচনায় পরিচ্ছন্ন কাব্যরূপ লাভ করিয়াছে । কবি বলিয়াছেন, “যা ছিল শোক, আজ তাই হয়েছে শান্তি ।”** “বর্ষা ও শরৎ’ পরিচ্ছেদে উল্লিখিত বর্ষস্মৃতি প্রসঙ্গে ‘বালক’ পত্রিকায় প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের “বর্ষার চিঠি” রচনাটির কিয়দংশ উদধূত হইল। বলা বাহুল্য, এই স্মৃতিচিত্রটি ‘জীবনস্মৃতি'র বহু পূর্বের রচনা । ছেলেবেলায় যেমন বর্ষা দেখতেম, তেমন ঘনিয়ে বর্ষাও এখন হয় না । বর্ষার তেমন সমারোহ নেই যেন, বর্ষা এখন যেন ইকনমিতে মন দিয়েছে- নমো নমো করে জল ছিটিয়ে চলে যায়কেবল খানিকটা কাদা, খানিকটা ছাট, খানিকটা অসুবিধে মাত্ৰ— একখানা ছেড়া ছাতা ও ৪২ রবীন্দ্র-জীবনী ১ (বৈশাখ ১৩৭৭), পৃ. ১৯৪ ৪৩ ‘প্রথম শোক', লিপিকা ('কথিকা’- সবুজপত্র, আষাঢ় ১৩২৬) 8V