পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৬৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন 86 (t যার প্রতিষ্ঠ। তার সম্বন্ধেও প্রত্যক্ষতার স্কুল আবদার চলে না। আমরা দেখতে পারি, ভারি জিনিস হাত থেকে পড়ে যায় কিন্তু মহাকর্ষণকে দেখতে পারি নে। অত্যন্ত মুঢ়ও যদি বলে, “আমি সমুদ্র দেখব, আমি হিমালয় পর্বত দেখব, তবে তাকে এ-কথা বলতে হয় না যে, ‘আগে তোমার চোখদুটোকে মস্ত-বড়ো করে তোলে। তবে তোমাকে পর্বত সমুদ্র দেখিয়ে দিতে পারব – কিন্তু সেই মুঢ়ই যখন ভূবিদ্যার কথা জিজ্ঞাসা করে তখন তাকে বলতেই হয়, একটু রোসো ; গোড়া থেকে শুরু করতে হবে ; আগে তোমার মনকে সংস্কারের আবরণ থেকে মুক্ত করে। তবে এর মধ্যে তোমার অধিকার হবে। অর্থাৎ চোখ মেললেই চলবে না, কান খুললেই হবে না, তোমাকে গুহার মধ্যে প্রবেশ করতে হবে।’ মুঢ় যদি বলে, 'না, আমি সাধনা করতে রাজী নই, আমাকে তুমি এসমস্তই চোখে-দেখা কানে-শোনার মতো সহজ করে দাও), তবে তাকে হয় মিথ্যা দিয়ে ভোলাতে হয়, নয় তার অনুরোধে কৰ্ণপাত করাও সময়ের বৃথা অপব্যয় বলে গণ্য করতে হয় । তাই যদি হয় তবে উপনিষৎ র্যাকে গুহাহিতং গহবরেষ্ঠং বলেছেন, যিনি গভীরতম, তাকে দেখাশোনার সামগ্রী করে বাইরে এনে ফেলবার অদ্ভূত আবদার আমাদের খাটতেই পারে না। এই আবদার মিটিয়ে দিতে পারেন এমন গুরুকে আমরা অনেকসময় খুজে থাকি, কিন্তু যদি কোনো গুরু বলেন, “আচ্ছা বেশ, তাকে খুব সহজে করে দিচ্ছি”— ব’লে সেই যিনি নিহিতং গুহায়াং তাকে আমাদের চোখের সমুখে যেমন-খুশি একরকম করে দাড় করিয়ে দেন, তা হলে বলতেই হবে, তিনি অসত্যের দ্বারা গোপনকে আরো গোপন করে দিলেন । এ-রকম স্থলে শিষ্যকে এই কথাটাই বলবার কথা যে, মানুষ যখন সেই গুহাহিতকে, সেই গভীরকে চায়, তখন তিনি গভীর ব’লেই তাকে চায়— সেই গভীর আনন্দ আর-কিছুতে মেটাতে পারে না ব’লেই তাকে চায়— চোখেদেখা কানে-শোনার সামগ্রী জগতে যথেষ্ট আছে, তার জন্যে আমাদের বাইরের মানুষটা তো দিনরাত ঘুরে বেড়াচ্ছে কিন্তু আমাদের অস্তরতর গুহাহিত তপস্বী সে সমস্ত-কিছু চায় না ব’লেই একাগ্রমনে র্তার দিকে চলেছে। তুমি যদি তাকে চাও তবে গুহার মধ্যে প্রবেশ করেই তার সাধনা করো— এবং যখন তাকে পাবে, তোমার ‘গুহাশয় রূপেই র্তাকে পাবে ; অন্য রূপে যে তাকে চায় সে র্তাকেই চায় না ; সে কেবল বিষয়কেই অন্য একটা নাম দিয়ে চাচ্ছে । মানুষ সকল পাওয়ার চেয়ে র্যাকে চাচ্ছে, তিনি সহজ বলেই তাকে চাচ্ছে না— তিনি ভূমা বলেই তাকে চাচ্ছে। যিনি ভূমা, সর্বত্রই তিনি গুহাহিতং, কি সাহিত্যে কি ইতিহাসে, কি শিল্পে কি ধর্মে কি কর্মে । এই যিনি সকলের চেয়ে বড়ো, সকলের চেয়ে গভীর, কেবলমাত্র তাকে চাওয়ার