পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫১৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

6 o o রবীন্দ্র-রচনাবলী পাওয়া যায়, হৃদয়ের মধ্যে প্রত্যক্ষ পাওয়া যায়— শুধু জ্ঞানে জানা যায় তা নয়, রসে পাওয়া যায়, কেননা সমস্ত রসের সার তিনি— রসো বৈ সঃ । যিনি হৃদয় দিয়ে ব্রহ্মকে পেয়েছেন, তিনি উপনিষদের এই মহাবাক্যের অর্থ বুঝেছেন— যতো বাচো নিবর্তন্তে অপ্রাপা মনসা সহ আনমং ব্রহ্মণে বিদ্বান ন বিভেতি কুতশন। জ্ঞান যখন তাকে পেতে চায় এবং বাক্য প্রকাশ করতে চায় তখন বারবার ফিরে ফিরে আসে, কিন্তু আনন্দ দিয়ে যখন সেই আনন্দের যোগ হয় তখন সেই প্রত্যক্ষ যোগে সমস্ত ভয় সমস্ত সংশয় দূর হয়ে যায়। আনন্দের মধ্যে সমস্ত বোধের পরিপূর্ণতা— মন ও হৃদয়ের, জ্ঞান ও ভক্তির অখণ্ড যোগ । আনন্দ যখন জাগে তখন সকলকে সে আহবান করে ; সে গণ্ডির মধ্যে আপনাকে নিয়ে আপনি রুদ্ধ হয়ে বসে থাকতে পারে না । সে এ-কথা কাউকে বলে না যে ‘তুমি দুর্বল, তোমার সাধ্য নেই, কেননা আনন্দের কাছে কোনো কঠিনতাই কঠিন নয়— আনন্দ সেই আনন্দের ধনকে এতই একান্ত ক’রে এতই নিবিড় ক’রে দেখে যে, সে র্তাকে দুষ্প্রাপ্য বলে কোনো লোককেই বঞ্চিত করতে চায় না— পথ যত দীর্ঘ যত দুর্গম হ’ক-না, এই পরমলাভের কাছে সে কিছুই নয়। এই কারণে পৃথিবীতে এ-পর্যন্ত যে-কোনো মহাত্মা আনন্দ দিয়ে তাকে লাভ করেছেন, তারা অমৃতভাণ্ডারের দ্বার বিশ্বজনের কাছে খুলে দেবার জন্যেই দাড়িয়েছেন —আর র্যারা কেবলমাত্র জ্ঞান বা কেবলমাত্র আচারের মধ্যে নিবিষ্ট, তারাই পদে পদে ভেদবিভেদের দ্বারা মানুষের পরস্পর মিলনের উদার ক্ষেত্রকে একেবারে কণ্টকাকীর্ণ করে দেন। র্তারা কেবল না-এর দিক থেকে সমস্ত দেখেন, হা-এর দিক থেকে নয়— এইজন্যে র্তাদের ভরসা নেই, মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা নেই এবং ব্রহ্মকেও তারা নিরতিশয় শূন্ততার মধ্যে নির্বাসিত করে রেখে দেন। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের চিত্তে যখন ধর্মের ব্যাকুলত প্রবল হল তখন তিনি-যে অনন্ত নেতি নেতিকে নিয়ে পরিতৃপ্ত হতে পারেন নি সেটা আশ্চর্যের বিষয় নয়, কিন্তু তিনিযে সেই ব্যাকুলতার বেগে সমাজের পরিবারের চিরসংস্কারগত অভ্যস্ত পথে র্তার থিত হৃদয়কে সমর্পণ করে দিয়ে কোনোমতে তার কান্নাকে থামিয়ে রাখতে চেষ্টা করেন নি এইটেই বিস্ময়ের বিষয় । তিনি কাকে চাচ্ছেন তা ভালো করে জানবার পুর্বেই তাকেই চেয়েছিলেন– জ্ঞান র্যাকে চিরকালই জানতে চায় এবং প্রেম র্যাকে চিরকালই পেতে থাকে।