পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫২১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন 6 o' বিশ্বের কত হাজাররকম আঘাতের ঢেউ আমাদের চেতনার উপরে ঢেউ খেলিয়ে উঠতে থাকে, তখনি আমাদের জাগা— আমাদের শক্তির সঙ্গে যখন বিশ্বের শক্তির যোগ দুই দিক থেকেই সম্পূর্ণ হয়ে ওঠে তখনি জাগা । 冒 অতিথি যেমন নিদ্রিত ঘরের দ্বারে ঘা মারে, সমস্ত জগৎ অহরহ তেমনি করে আমাদের জীবনের দ্বারে ঘা মারছে, বলছে ‘জাগো । প্রত্যেক শক্তির উপরে বিরাট শক্তির স্পর্শ আসছে, বলছে ‘জাগো । যেখানে সেই বড়োর আহবানে আমাদের ছোটোটি তখনি সাড়া দিচ্ছে সেইখানেই প্রাণ, সেইখানেই বল, সেইখানেই আনন্দ । আমাদের হাজার তারের বীণার প্রত্যেক তারেই ওস্তাদের আঙুল পড়ছে, প্রত্যেক তারটিকেই বলছে ‘জাগো । যে তারটি জাগছে সেই তারেই সুর, সেই তারেই সংগীত । ষে-তার শিথিল, যে-তার জাগছে না, সেই তারে আনন্দ নেই, সেই তারটিকে সেরেতোলা বেঁধে-তোলার অনেক দুঃখের ভিতর দিয়ে তবে সেই সংগীতের সার্থকতার মধ্যে গিয়ে পৌছতে হয়। এই-রকম আঘাতের পর আঘাত লেগে আমরা যে কত শত জাগার মধ্যে দিয়ে জাগতে জাগতে এসেছি, তা কি আমরা জানি। প্রত্যেক জাগার সম্মুখে কত নব নব অপুর্ব আনন্দ উদঘাটিত হয়েছে, তা কি আমাদের স্মরণ আছে। জড় থেকে চৈতন্য, চৈতন্য থেকে আনন্দের মাঝখানে স্তরে স্তরে কত ঘুমের পর্দা একটি একটি করে খুলে গিয়েছে, তা অতীত যুগযুগান্তরের পাতায় পাতায় লেখা রয়েছে— মহাকালের দপ্তরের সেই বই কে আজ খুলে পড়তে পারবে। অনন্তের মধ্যে আমাদের এই-যে জাগরণ, এই-যে নানাদিকের জাগরণ— গভীর থেকে গভীরে, উদার থেকে উদরে জাগরণ, এই জাগরণের পালা তো এখনো শেষ হয় নি। সেই চিরজাগ্রত পুরুষ যিনি কালে কালে আমাদের চিরদিন জাগিয়ে এসেছেন— তিনি র্তার হাজারমহল বিশ্বভবনের মধ্যে আজি এই মনুষ্যত্বের সিংহদ্বারটা খুলে আমাদের ডাক দিয়েছেন– এই মনুষ্যত্বের মুক্ত দ্বারে অনস্তের সঙ্গে মিলনের জাগরণ আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে—সেই জাগরণে এবার যার সম্পূর্ণ জাগা হল না, ঘুমের সকল আবরণগুলি খুলে যেতে-না-যেতে মানবজন্মের অবকাশ যার ফুরিয়ে গেল, স কৃপণঃ, সে কৃপাপাত্র। মনুষ্যত্বের এই-যে জাগা, এও কি একটিমাত্র জাগরণ । গোড়াতেই তো আমাদের দেহশক্তির জাগা আছে— সেই জাগাটাই সম্পূর্ণ হওয়া কি কম কথা। আমাদের চোখকান আমাদের হাতপা তার সম্পূর্ণ শক্তিকে লাভ ক’রে সজাগভাবে শক্তির ক্ষেত্রে এসে দাড়িয়েছে, আমাদের মধ্যে এমন কয়জন আছে ? তার পর মনের জাগা আছে, হৃদয়ের জাগা আছে, আত্মার জাগা আছে— বুদ্ধিতে জাগা, প্রেমেতে জাগা, ভূমানন্দে জাগা