পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫২৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৫১২ রবীন্দ্র-রচনাবলী মুহূর্তে ঝংকারও দিচ্ছেন। কেবলই নিয়ম ? তা তো নয়। তার সঙ্গে-সঙ্গেই আনন্দ । প্রতিদিন খেতে হচ্ছে বটে পেটের দায়ের অত্যন্ত কঠোর নিয়মে, কিন্তু তার সঙ্গে-সঙ্গেই মধুর স্বাদটুকুর রাগিণী রসনায় রসিত হয়ে উঠছে। আত্মরক্ষার বিষম চেষ্টায় প্রত্যেক মুহূর্তেই বিশ্বজগতের শতসহস্র নিয়মকে প্রাণপণে মানতে হচ্ছে বটে, কিন্তু সেই মেনে চলবার চেষ্টাতেই আমাদের শক্তির মধ্যে আনন্দের ঢেউ খেলিয়ে উঠছে। দায়ও যেমন কঠোর, খুশিও তেমনি প্রবল । সেই আমাদের ওস্তাদের হাতে বাজবার সুবিধেই হচ্ছে ওই । তিনি সব স্বরের রাগিণীই জানেন । যে-ক’টি তার বাধা হচ্ছে, তাতে যে-ক’টি স্বর বাজে, কেবলমাত্র সেই ক’টি নিয়েই তিনি রাগিণী ফলিয়ে তুলতে পারেন। পাপী হ’ক, মুঢ় হ’ক, স্বার্থপর হ’ক, বিষয়ী হ’ক, যে হ’ক-না, বিশ্বের আনন্দের একটা সুরও বাজে না এমন চিত্ত কোথায় । তা হলেই হল ; সেই সুযোগটুকু পেলেই তিনি আর ছাড়েন না। আমাদের অসাড়তমেরও হৃদয়ে প্রবল ঝনঝনার মাঝখানে হঠাৎ এমন একটাকিছু মুর বেজে ওঠে যার যোগে ক্ষণকালের জন্যে নিজের চারদিককে ছাড়িয়ে গিয়ে চিরন্তনের সঙ্গে মিলে যাই । এমন একটা-কোনো স্থর, নিজের প্রয়োজনের সঙ্গে অহংকারের সঙ্গে যার মিল নেই— যার মিল আছে আকাশের নীলিমার সঙ্গে, প্রভাতের আলোর সঙ্গে ; যার মিল আছে ত্যাগীর ত্যাগের সঙ্গে, বীরের অভয়ের সঙ্গে, সাধুর প্রসন্নতার সঙ্গে ; সেই স্বরটি যখন বাজে তখন মায়ের কোলের অতিক্ষুদ্র শিশুটিও আমাদের সকল স্বার্থের উপরে চেপে বসে ; সেই সুরেই আমরা ভাইকে চিনি, বন্ধুকে টানি, দেশের কাজে প্রাণ দিই ; সেই স্বরে সত্য আমাদের দুঃসাধ্য সাধনের দুর্গম পথে অনায়াসে আহবান করে ; সেই সুর যখন বেজে ওঠে তখন আমরা জন্মদরিদ্রের এই চিরাভ্যস্ত কথাটা মুহূর্তেই ভুলে যাই যে, আমরা ক্ষুধাতৃষ্ণার জীব, আমরা জন্মমরণের অধীন, আমরা স্তুতিনিন্দায় আন্দোলিত ; সেই স্বরের স্পন্দনে আমাদের সমস্ত ক্ষুদ্র সীমা স্পন্দিত হয়ে উঠে আপনাকে লুকিয়ে অসীমকেই প্রকাশ করতে থাকে। সে স্বর যখন বাজে না তখন আমরা ধূলির ধূলি, আমরা প্রকৃতির অতিভীষণ প্রকাও যন্ত্রটার মধ্যে আবদ্ধ একটা অত্যন্ত ক্ষুদ্র চাকা, কার্যকারণের শৃঙ্খলে আষ্ট্রেপৃষ্ঠে জড়িত। তখন বিশ্বজগতের কল্পনাতীত বৃহত্ত্বের কাছে আমাদের ক্ষুদ্র আয়তন লজ্জিত, বিশ্বশক্তির অপরিমেয় প্রবলতার কাছে আমাদের ক্ষুদ্র শক্তি কুষ্ঠিত। তখন আমরা মাথা ইেট করে দুই হাত জোড় করে অহোরাত্র ভয়ে ভয়ে বাতাসকে আলোকে স্বর্ধকে চন্দ্রকে পর্বতকে নদীকে নিজের চেয়ে বড়ো ব’লে দেবতা ব'লে ষখন-তখন যেখানে-সেখানে প্রণাম করে করে বেড়াই । তখন আমাদের সংকল্প সংকীর্ণ, আমাদের আশা ছোটো,