পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১১৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

८छb Ο Σ. Σ ভক্তির লাঘব হয় নাই? তবে কিরূপে আশা করা যায় পর্বে যেরূপ অচলা নিষ্ঠার সহিত বিধবারা ব্ৰহ্মচর্য পালন করিতেন, এখনও তাহারা সেইরূপ পরিবেন? এখন বলপূর্বক সেই বাহ্য অনুষ্ঠান অবলম্বন করাইলে কি সমাজে উত্তরোত্তর গুরুতর অধৰ্মাচরণ প্ৰবেশ করিয়া নিদারুণ অমঙ্গলের সৃষ্টি করিবে না ? বিধবাবিবাহের সম্বন্ধে আরো একটা কথা আছে। আমাদের সমাজে একান্নাবতী পরিবারের মূল শিথিল হইয়া আসিতেছে। গুরুজনের প্রতি অচলা ভক্তি ও আত্মমত বিসর্জনই একান্নাবতী পরিবারের প্রতিষ্ঠাস্থল। এখন সাম্যনীতি সমাজে বন্যার মতো আসিয়াছে, কোঠা বাড়ি হইতে কঞ্চির বেড়া পর্যন্ত উচু জিনিস যাহা-কিছু আছে সমস্তই ভাসাইয়া লইয়া যাইতেছে। তাহা ছাড়া শিক্ষাও যত বাড়িতেছে, মতভেদও তত বাড়িতেছে। দুই সহােদর ভ্রাতার জীবনযাত্রার প্রণালী ও মতে মিলে না, তবে আর বেশি দিন একত্র থাকা সম্ভবে না। একান্নাবতী পরিবার-প্রথা ভাঙিয়া গেলে স্বামীর মৃত্যুর পর একাকিনী বিধবা কাহাকে আশ্রয় করিবে ? বিশেষত তাহার যদি ছোটাে ছোটাে দুই-একটি ছেলে থাকে। তবে তাহদের পড়ানো শুনানো রক্ষণাবেক্ষণ কে করিবে ? আজকাল যেরাপ অবস্থা ও সমাজ যে দিকে যাইতেছে, তাহারই উপযোগী পরিবর্তন ও শিক্ষা হওয়া কি উচিত নয় ? কিন্তু যতদিন একান্নবর্তিত্ব একেবারে না ভাঙিয়া যায় ততদিনই বা বিধবাবিবাহ সুচারুরূপে সম্পন্ন হইবে কী করিয়া ? স্বামী ব্যতীত শ্বশুরালয়ের আর কাহারও সহিত যাহার তেমন ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ ছিল না, সে রমণী স্বামীর মৃত্যুর পরে বিবাহ করিয়া শ্বশুরালয়ের সহিত একেবারেই বিচ্ছিন্ন হইতে পারে, তাহাতে আপত্তি দেখি না। কিন্তু একান্নাবতী পরিবারে শ্বশুরালয়ে স্বামী ছাড়াও কত শত বন্ধন। অতএব স্বামীর মৃত্যুতেই শ্বশুরালয় হইতে ধর্মত মুক্তি লাভ করা যায় না। এতদিন যাহাদের সহিত রোগে শোকে বিপদে উৎসবে অনুষ্ঠানে সুখদুঃখের আদানপ্ৰদান চলিয়া আসিয়াছে, যাহাদের গৌরব ও কলঙ্ক তোমার নিকট কিছুই গোপন নাই, যেখানকার শিশুরা তোমার স্নেহের উপরে নির্ভর করে, সমবয়স্কেরা তোমার মমতা ও সাস্ত্ৰনার উপর নির্ভর করে, গুরুজনেরা তোমার সেবার উপর নির্ভর করে, সেখান হইতে তুমি কোনোক্রমে আপনাকে বিচ্ছিন্ন করিতে পার না। তাহা হইলে ধর্ম থাকে না, পরিবারে সুখশান্তি থাকে না। সমাজের ক্ষতি হয়। বিশেষত বিধবার যদি সন্তান থাকে, তাহাদিগকে এক বংশ হইতে আর এক বংশে লইয়া গেলে পরিবারে অসুখ ও অশান্তি উপস্থিত হয়, যদি না লইয়া যাওয়া হয় তবে সন্তানেরা মাতৃহীন হইয়া থাকে। ইংরাজি-শিক্ষিত অনেকের এমন মত আছে যে, স্ত্রীলোকদিগকে অন্তঃপুরের বাহির করা উচিত হয় না, তাহাতে তাহদের অন্তঃপুরসুলভ কমনীয়তা প্রভৃতি গুণ নষ্ট হইয়া যায়। এ কথার সত্যমিথ্যা গুণাগুণ লইয়া আমি বিচার করিতে বসি নাই। পূর্বেই এক প্রকার বলিয়াছি, সমাজের বর্তমান বিপ্লবের অবস্থায় কোন কাজটা সমাজের পক্ষে সর্বতোভাবে উপযোগী, কোনটা নয়, তাহা নিঃসংশয়ে বলা যায় न् । বঙ্গনারীদের মুখপদ্ম যদি দুৰ্ভাগা সূর্যের তৃষিত নেত্রপথের অন্তরাল করাই অভিপ্রেত হয় তবে বর্তমান বঙ্গসমাজে তাহার কতকগুলি বাধা পড়িয়াছে, আমি তাহাই দেখিতে চাই। একটা দৃষ্টান্ত দেখিলেই আমার কথা স্পষ্ট হইবে। প্রাচীন কালে দেশ-বিদেশে যাতায়াতের তেমন সুবিধা ছিল নাব্যয় অধিক এবং পথে বিপদও অনেক ছিল। এইজনা তখনকার রীতি ছিল “পথে নারী বিবর্জিত”। এইজন্য পুরাকালের পথিকগণের বন্ধুজন-বিলাপে কাব্য প্ৰতিধ্বনিত হইত। কিন্তু এখন সময়ের পরিবর্তন হইয়াছে। রেলের প্রসাদে পথ সুগম হইয়াছে, পথে বিপদও নাই। দেশে বিদেশে বাঙালিদের কাজকর্ম হইতেছে। যখন পথ সুগম, ব্যয় অল্প. কোনো বিপদ নাই, তখন শ্ৰীপুত্রের বিরহ কাহারও সহ্য হয় না। কিন্তু রেলের এক-একটি গাড়ি একলা অধিকার করিতে পারেন এমন সংগতিও অল্প লোকের আছে। এইজন্য আজকাল প্ৰায় দেখা যায় পরপুরুষদিগের সহিত একত্রে উপবেশন করিয়া অনেক ভদ্রলোকের পরিবার রেলগাড়িতে যাত্ৰা করিতেছেন। উত্তরোত্তর এরূপ উদাহরণ আরো বাড়িতে থাকিবে। ইহা নিবারণ করা অসাধ্য। নিয়মের গ্ৰন্থি দুই-চারিবার খুলিয়া ফেলিলেই তাহা শিথিল