পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১২৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সমালোচনা S S GSo করিবে, তেমনি আমরা যদি একটি সূচি গোপন করিবার জন্য আলো নিবাইয়া দিই, তবে তাহাতে সমস্ত ঘর অন্ধকার হইবে, তেমনি আমরা যদি সমস্ত জাতিকে কোনো উপকার সাধনের জন্য মিথ্যাচরণ শিখাই তবে সেই মিথ্যাচরণ যে আমার ইচ্ছার অনুসরণ করিয়া কেবলমাত্র উপকারটুকু কবিয়াই অম্ভহিত হইবে তাহা নহে, তাহার বংশ সে স্থাপনা করিয়া যাইবে। পূর্বেই বলিয়াছি বৃহত্ত্ব একটি মাত্ৰ উদ্দেশ্যের মধ্যে বদ্ধ থাকে না, তাহার দ্বারা সহস্ৰ উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়। সূর্যকিরণ উত্তাপ দেয়, আলোক দেয়, বর্ণ দেয়, জড় উদ্ভিদ পশু পক্ষী কীট পতঙ্গ সকলেরই উপরে তাহার সহস্র প্রকারের প্রভাব কার্য করে; তোমার যদি এক সময়ে খেয়াল হয় যে পৃথিবীতে সবুজ বর্ণের প্রাদুর্ভাব অত্যন্ত অধিক হইয়াছে, অতএব সেটা নিবারণ করা আবশ্যক ও এই পরম লোকহিতকর উদ্দেশে যদি একটা আকাশ-জোড়া ছাতা তুলিয়া ধরে তবে সবুজ রঙ তিরোহিত হইতেও পারে। কিন্তু সেইসঙ্গে লাল রঙ নীলরঙ সমূদয় রঙ মারা যাইবে- পৃথিবীর উত্তাপ যাইবে, আলোক যাইবে, পশু পক্ষী কীট পতঙ্গ সবাই মিলিয়া সরিয়া পড়িবে। তেমনি কেবলমাত্র political উদ্দেশ্যেই সত্য বদ্ধ নহে! তাহার প্রভাব মনুষ্যসমাজের অস্থি মজ্জার মধ্যে সহস্র আকারে কার্য করিতেছে- একটি মাত্র উদ্দেশ্য-বিশেষের উপযোগী করিয়া যদি তাহার পরিবর্তন করো, তবে সে আর আর শত সহস্র উদ্দেশ্যের পক্ষে অনুপযোগী হইয়া উঠিবে। যেখানে যত সমাজের ধ্বংস হইয়াছে এইরূপ করিয়াই হইয়াছে। যখনই মতিভ্রমবশত একটি সংকীর্ণ হিত সমাজের চক্ষে সর্বেসর্বা হইয়া উঠিয়াছে, এবং অনন্ত হিতকে সে তাহার নিকটে বলিদান দিয়াছে, তখনই সেই সমাজের মধ্যে শনি প্ৰবেশ করিয়াছে, তাহার কলি ঘনাইয়া আসিয়াছে। একটি বস্তা সর্ষপের সদগতি করিতে গিয়া ভরা নৌকা ডুবাইলে বাণিজ্যের যেরূপ উন্নতি হয় উপরি-উক্ত সমাজের সেইরূপ উন্নতি হইয়া থাকে। অতএব স্বজাতির যথার্থ উন্নতি যদি প্রার্থনীয় হয়, তবে কল কৌশল ধূর্ততা চাণক্যতা পরিহার করিয়া যথার্থ পুরুষের মতো, মানুষের মতো, মহন্ত্রের সরল রাজপথে চলিতে হইবে; তাহাতে গম্যস্থানে পৌঁছিতে যদি বিলম্ব হয় তাহাও শ্রেয়, তথাপি সুড়ঙ্গপথে অতি সত্বরে রসাতলরাজ্যে গিয়া উপনিবেশ স্থাপন করা সবথা পরিহর্তব্য। পাপের পথে ধ্বংসের পথে যে বড়ো বাডো দেউডি আছে সেখানে সমাজের প্রহরীরা বসিয়া থাকে, সুতরাং সে দিক দিয়া প্ৰবেশ করিতে হইলে বিস্তর বাধা পাইতে হয়; কিন্তু ছোটাে খিড়কির দুয়ারগুলিই ভয়ানক, সে দিকে তেমন কড়াক্কড় পাহারা নাই ; অতএব, বাহির হইতে দেখিতে যেমনই হউক, ধ্বংসের সেই পথগুলিই প্ৰশান্ত । একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। যখনই আমি মনে করি “লোকহিতার্থে যদি একটা মিথ্যা কথা বলি তাহাতে তেমন দোষ নাই।” তখনই আমার মনে যে বিশ্বাস ছিল “সত্য ভালো”, সে বিশ্বাস সংকীর্ণ হইয়া যায়, তখন মনে হয় “সত্য ভালো, কেননা সত্য আবশ্যক” । সুতরাং যখনই ক্ষুদ্ৰ বুদ্ধিতে কল্পনা করিলাম লোকহিতের জন্য সত্য আবশ্যক নহে, তখন স্থির হয় মিথ্যাই ভালো। সময়বিশেষে সত্য মন্দ, মিথ্যা ভালো, এমন যদি আমার মনে হয়, তবে সময়বিশেষেই বা তাহকে বন্ধ রাখি কেন ? লোকহিতের জন্য যদি মিথ্যা বলি, তো আত্মহিতের জন্যই বা মিথ্যা না বলি কেন ? উত্তর- আত্মাহিত অপেক্ষা লোকহিত ভালো। প্ৰশ্ন- কেন ভালো ? সময়বিশেষে সত্যই যদি ভালো না হয়, তবে লোকহিতই যে ভালো এ কথা কে বলিল ? উত্তর- লোকহিত আবশ্যক বলিয়া ভালো। প্ৰশ্ন- কাহার পক্ষে আবশ্যক ? উত্তর- আত্মাহিতের পক্ষেই আবশ্যক। তদুত্তর- কই, তাহা তো সকল সময় দেখা যায় না। এমন তো দেখিয়াছি পরের অহিত করিয়া আপনার হিত হইয়াছে। উত্তর- তাহাকে যথার্থ হিত বলে না। প্রকেল্প- তবে কাহাকে বলে ?