পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১৫৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

KraN S 80 বিলাসিতায় নিমগ্ন হন তাহদের স্বার্থপরতা সর্বপ্রকার আঘাত হইতে সুরক্ষিত হইয়া সুদৃঢ় হইয়া উঠে। বৃক্ষে যে ফল থাকে সে ফল বৃক্ষ হইতে রস আকর্ষণ করিয়া পরিপক্ক হইয়া উঠে। যতই সে পরিপাক হইতে থাকে ততই বৃক্ষের সহিত তাহার বৃন্তবন্ধন শিথিল হইয়া আসে, অবশেষে তাহার অভ্যন্তরস্থ বীজ সুপরিণত হইয়া উঠিলে বৃক্ষ হইতে সে সহজেই বিচ্ছিন্ন হইয়া বীজকে সার্থক করিয়া তোলে। আমরাও সংসারবৃক্ষ হইতে সেইরূপ বিচিত্র রস আকর্ষণ করি— মনে হইতে পারে তাহাতে সংসারের সহিত আমাদের সম্বন্ধ ক্রমেই দৃঢ় হইবে- কিন্তু তাহা নহে, আত্মার যথার্থ পরিণতি হইলে বন্ধন আপনি শিথিল হইয়া আসে। ফলের সহিত আমাদের প্রভেদ এই যে, আত্মা সচেতনা; রাস নির্বাচন ও আকর্ষণ বহুল পরিমাণে আমাদের স্বায়ত্ত। আত্মার পরিণতির প্রতি লক্ষ করিয়া বিচারপূর্বক সংসার হইতে রস গ্রহণ ও বর্জন করিতে পারিলেই সংসারের উদ্দেশ্য সফল হয় এবং সেইসঙ্গে আত্মার সফলতা সম্পন্ন হইলে সংসারের কল্যাণবন্ধন সহজেই শিথিল হইয়া আসে। অতএব ঈশ্বরের দ্বারা সমস্ত আচ্ছন্ন জানিয়া সংসারকে তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা, তাহার দত্ত সুখসমৃদ্ধির দ্বারা ভোগ করিবে- সংসারকে শেষ পরিণাম বলিয়া ভোগ করিতে চেষ্টা করিবে না। অপরপক্ষে সংসারের বৃন্তবন্ধন বলপূর্বক বিচ্ছিন্ন করিয়া তাহার মঙ্গলরাস হইতে আত্মাকে বঞ্চিত করিবে না। ঈশ্বর এই সংসারবৃক্ষের সহস্র তন্তুর মধ্য দিয়া আমাদের আত্মার কল্যাণরস প্রেরণ করেন; এই জীবধারায়িতা বিপুল বনস্পতি হইতে দম্ভভরে পৃথক হইয়া নিজের রস নিজে জোগাইবার ক্ষমতা আমাদের হস্তে নাই। নগণ্য করিয়া যে অন্ধ আনন্দ উপভোগ করে সে আনন্দের শ্রেয়স্কর্যতা নাই। বিদ্যা এবং অবিদ্যা, সৎ এবং অসৎ, ব্ৰহ্ম এবং সংসার উভয়কেই স্বীকার করিতে হইবে। দুঃখের হাত এড়াইবার জন্য কর্তব্যবন্ধন ছেদন করিবার অভিপ্ৰায়ে সংসারকে একেবারেই “না” করিয়া দিয়া একাকী আনন্দ সম্ভোগে প্ৰবৃত্ত হওয়া একজাতীয় প্ৰমত্ততা। সত্যের এক দিককে উপেক্ষা করিলে অপর দিকও অসত্য হইয়া উঠে। ঈশ্বরের আদেশপালনকে যে অস্বীকার করে, সে মুখে যাহাই বলুক, ঈশ্বরকে সম্পূৰ্ণ স্বীকার করে না। বরঞ্চ ঈশ্বরকে মুখে অস্বীকার করিয়া যে ব্যক্তি মনুষ্যের প্রতি কর্তব্যানুষ্ঠান করে, সে কঠিন কর্মের দ্বারা ঈশ্বরকে স্বীকার করিয়া থাকে। জ্ঞানে এবং ভোগে এবং কর্মে ব্ৰহ্মকে স্বীকার করিলেই তাহাকে সম্পূর্ণভাবে স্বীকার করা হয়। সেইরূপ সর্বাঙ্গীণভাবে ব্ৰহ্মাকে উপলব্ধি করিবার একমাত্র স্থান এই সংসার, আমাদের এই কর্মক্ষেত্ৰ; ইহাই আমাদের ধর্মক্ষেত্ৰ, ইহাই ব্ৰহ্মের মন্দির। এখানে জগৎমণ্ডলের জ্ঞানে ঈশ্বরের জ্ঞান, জগৎসৌন্দর্যের ভোগে ঈশ্বরের ভোগ এবং জগৎসংসারের কর্মে ঈশ্বরের কর্ম জড়িত রহিয়াছে; সংসারের সেই জ্ঞান সৌন্দর্য ও ক্রিয়াকে ব্ৰহ্মের দ্বারা বেষ্টিত করিয়া জানিলেই ব্ৰহ্মকে অন্তরতর করিয়া জানা যায় এবং সংসারযাত্ৰাও কল্যাণকর হইয়া উঠে। তখন ত্যাগ ও ভোগের সামঞ্জস্য হয়, কাহারও ধনে লোভ থাকে না, অনৰ্থক বলিয়া জীবনের প্রতি উপেক্ষা জন্মে না, শতবর্ষ। আয়ু যাপন করিলেও পরমায়ুর সার্থকতা উপলব্ধি হয়, এবং সেই অবস্থায়— যন্ত সর্ববাণি ভুতানি আত্মনোবানুপশ্যতি সর্বভুতেষু চাত্মানং ততো ন বিজুগুপ্তসতে। যিনি সমস্ত ভূতকে পরমাত্মার মধ্যে দেখেন, এবং সর্ব ভূতের মধ্যে পরমাত্মাকে দেখেন তিনি কাহাকেও ঘূণা করেন না। গম্যস্থানের পক্ষে পথ যেমন একই কালে পরিহার্য এবং অবলম্বনীয়, ব্ৰহ্মলাভের পক্ষে সংসার সেইরূপ। পথকে যেমন আমরা প্রতিপদে পরিত্যাগ করি এবং আশ্রয় করি, সংসারও সেইরূপ আমাদের প্রতিপদে বর্জনীয় এবং গ্রহণীয়। পথ নাই বলিয়া চক্ষু মুদিয়া পথপ্ৰান্তে পড়িয়া স্বপ্ন দেখিলে গৃহ লাভ হয় না, এবং পথকেই শেষ লক্ষ্য বলিয়া বসিয়া থাকিলে গৃহ গমন ঘটে না। গম্যস্থানকে যে ভালোবাসে পথকেও সে ভালোবাসে- পথ গম্যস্থানেরই অঙ্গ, অংশ এবং আরম্ভ বলিয়া গণ্য। ব্ৰহ্মকে যে চায়, ব্ৰহ্মের সংসারকে সে উপেক্ষা করিতে পারে না; সংসারকে সে প্রীতি করে এবং সংসারের S (2 ISO