পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১৭২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ঔপনিষদ ব্ৰহ্ম S نوم তিনি আছেন এই কথা যে বলে সে ছাড়া অন্য ব্যক্তি তাহাকে কী করিয়া উপলব্ধি করিবে? তিনি আছেন ইহার অধিক আর কী বলিবার আছে? তিনি আছেন এ কথা যখনই আমরা সর্বান্তিঃকরণে সম্পূর্ণভাবে বলিতে পারি তখনই আমাদের মনােনেত্রের সম্মুখে অনন্ত শূন্য ওতপ্রোত পরিপূর্ণ হইয়া উঠে। তখনই যথার্থত বুঝিতে পারি যে, আমি আছি; বুঝিতে পারি যে, আমার বিনাশ নাই; আত্ম ও পর, জড় ও চেতন, দেশ ও কাল, নিষ্কল পরমাত্মার দ্বারা এক মুহুর্তেই অখণ্ডভাবে উদ্দীপ্ত হইয়া উঠে। তখন আমাদের এই পুরাতন পৃথিবীর দিকে চাহিলে ইহাকে আর ধূলিপিণ্ড বলিয়া বোধ হয় না, নিশীথনভোমণ্ডলের নক্ষত্রপুঞ্জের দিকে চাহিলে তাহারা শুদ্ধমাত্র অগ্নিস্ফুলিঙ্গরূপে প্ৰতীয়মান হয় না; তখন আমার অন্তরাত্মা হইতে আরম্ভ করিয়া ধূলিকণা, এই ভূমিতল হইতে আরম্ভ করিয়া নক্ষত্ৰলোক পর্যন্ত একটি শব্দ ধ্বনিহীন গাম্ভীর্যে উদগীত হইয়া উঠে- ওঁ; একটি বাক্য শুনিতে পাই- অস্তি, তিনি আছেন— এবং সেই একটি কথার মধ্যেই সমস্ত জগৎচবাচরের, সমস্ত কার্যকারণের সমস্ত অর্থ নিহিত পাওয়া যায়। সেই মহান অস্তি শব্দকে কোনো আকারের দ্বারা মূর্তি-দ্বারা সহজ করা যায় কি ? এমন সহজ কথা কি আর কিছু আছে যে “তিনি আছেন ? “আমি আছি। এ কথা যেমন জগতের সকল কথার অপেক্ষা সহজ, “তিনি আছেন। এ কথা না বলিলে ‘আমি আছি। এ কথা যে আদ্যোপান্ত নিরর্থক মিথ্যা হইয়া যায়। আমার অস্তিত্ব বলিতেছে, আমার আত্মা বলিতেছে- তিনি আছেন। সাকার মূর্তি কি তদপেক্ষা সহজ সাক্ষা আর কিছু দিতে পারে? ব্ৰহ্মের সেই বিশুদ্ধ ভাব কিরূপে মনন করিতে হইবে ?-- নৈনমূদ্ধং ন তিৰ্য্যঞ্চ ন মধ্যে পরিাজগ্রভৎ ন তস্য প্রতিমা অস্তি যস্য নাম মহদযশঃ। কি উর্ধবদেশ, কি তির্যক, কি মধ্যাদেশ, কেহ ইহাকে গ্রহণ করিতে পারে না- তাহার প্রতিমা নাই, তাহার নাম মহদযোেশ । প্রাচীন ভারতে সংসারবাসী জীবাত্মার লক্ষ্যস্থান এই পরমাত্মাকে বিদ্ধ করিবার মন্ত্র ছিল- ওঁ । প্ৰণবোধনুঃ শিরোহাত্মা ব্ৰহ্মতল্লক্ষ্যমুচ্যতে। তাহার প্রতিমা ছিল না, কোনো মূর্তিকল্পনা ছিল না— পূর্বতন পিতামহগণ তাহাকে মনন করিবার জন্য সমস্ত পবিত্যাগ করিয়া একটিমাত্র শব্দ আশ্রয় করিয়াছিলেন। সে শব্দ যেমন সংক্ষিপ্ত, তেমনি পরিপূর্ণ কোনো বিশেষ অর্থ-দ্বারা সীমাবদ্ধ নহে । সেই শব্দ চিত্তকে ব্যাপ্ত করিয়া দেয়, কোনো বিশেষ আকার -দ্বারা বাধা দেয় না; সেই একটিমাত্র ও শব্দের মহাসংগীত জগৎসংসারের ব্ৰহ্মরন্ধু হইতে যেন | |ਣ ব্ৰহ্মের বিশুদ্ধ আদশ রক্ষা করিবার জন্য পিতামহগণ কিরূপ যত্নবান ছিলেন ইহা হইতেই তাহার প্ৰমাণ হইবে। চিন্তার যত প্রকার চিহ্ন আছে। তন্মধ্যে ভাষাই সর্বাপেক্ষা চিন্তার অনুগামী। কিন্তু ভাষারও সীমা আছে, বিশেষ অর্থের দ্বারা সে আকারবদ্ধ— সুতরাং ভাষা আশ্রয় করিলে চিম্ভাকে ভাষাগত অর্থের চারি প্রাস্তের মধ্যে রুদ্ধ থাকিতে হয়। ওঁ একটি ধ্বনিমাত্র- তাহার কোনো বিশেষ নির্দিষ্ট অর্থ নাই। সেই ওঁ শব্দে ব্ৰহ্মের ধারণাকে কোনো অংশেই সীমাবদ্ধ করে না- সাধনা-দ্বারা আমরা ব্ৰহ্মকে যত দূর জানিয়াছি যেমন করিয়াই পাইয়াছি। এই ও শব্দে তাঁহা সমস্তই ব্যক্ত করে এবং বাক্ত করিয়াও সেইখনেই রেখা টানিয়া দেয় না। সংগীতের স্বর যেমন গানের কথার মধ্যে একটি অনির্বচনীয়তার সঞ্চার করে তেমনি ও শব্দের পরিপূর্ণ ধ্বনি আমাদের ব্ৰহ্মধানের মধ্যে একটি অনির্বাচনীয়তা অবতারণা করিয়া থাকে। বাহা প্ৰতিমা-দ্বারা আমাদের মানস ভাবকে খর্ব ও আবদ্ধ করে, কিন্তু এই ও ধ্বনির দ্বারা আমাদের মনের ভাবকে উন্মুক্ত ও পরিব্যাপ্ত কবিয়া দেয়। সেইজনা উপনিষদ বলিয়াছেন- ওমিতি ব্ৰহ্মা। ওম বলিতে ব্ৰহ্ম বুঝায়। ওমিতীদং সৰ্বং, এই যাহা-কিছু সমস্তই ওঁ ! ওঁ শব্দ সমস্তকেই সমাচ্ছন্ন করিয়া দেয়। অর্থ-বন্ধন-হীন কেবল একটি সুগভীর