পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/১৯০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

> ° o রবীন্দ্র-রচনাবলী ব্ৰজমোহন কহিলেন, “না-করা তোমার পক্ষে আরও বেশি অন্যায় হইতে পারে।” রমেশ আর কিছু বলিতে পারিল না। সে ভাবিতে লাগিল, “ইতিমধ্যে দৈবক্রমে সমস্ত ফাসিয়া যাইতে পারে।” রমেশের বিবাহের যে দিন স্থির হইয়াছিল, তাহার পরে এক বৎসর অকাল ছিল— সে ভাবিয়াছিল, কোনোক্রমে সেই দিনটা পার হইয়া তাহার এক বৎসর মেয়াদ বাড়িয়া যাইবে । কন্যার বাড়ি নদীপথ দিয়া যাইতে হইবে— নিতাস্ত কাছে নহে– ছোটে-বড়ো দুটো-তিনটে নদী উত্তীর্ণ হইতে তিন-চার দিন লাগিবার কথা । ব্রজমোহন দৈবের জন্য যথেষ্ট পথ ছাড়িয়া দিয়া এক সপ্তাহ পূর্বে শুভদিনে যাত্রা করিলেন। বরাবর বাতাস অনুকূল ছিল। শিমুলঘাটায় পৌছিতে পুরা তিন দিনও লাগিল না । বিবাহের এখনো চার দিন দেরি আছে । ব্রজমোহনবাবুর দু-চার দিন আগে আসিবারই ইচ্ছা ছিল। শিমুলঘাটায় তাহার বেহান দীন অবস্থায় থাকেন। ব্রজমোহনবাবুর অনেকদিনের ইচ্ছা ছিল, ইহার বাসস্থান র্তাহাদের স্বগ্রামে উঠাইয়া লইয়া ইহাকে মুখে-স্বচ্ছন্দে রাখেন ও বন্ধুঋণ শোধ করেন। কোনো আত্মীয়তার সম্পর্ক না থাকাতে হঠাৎ সে-প্রস্তাব করা সংগত মনে করেন নাই। এবারে বিবাহ উপলক্ষে তাহার বেহানকে তিনি বাস উঠাইয়া লইতে রাজি করাইয়াছেন । সংসারে বেহানের একটিমাত্র কন্যা— তাহার কাছে থাকিয়া মাতৃহীন জামাতার মাতৃস্থান অধিকার করিয়া থাকিবেন, ইহাতে তিনি আপত্তি করিতে পারিলেন না। তিনি কহিলেন, “যে যাহা বলে বলুক, ষেপানে আমার মেয়ে-জামাই থাকিবে, সেখানেই আমার স্থান ।” বিবাহের কিছুদিন আগে আসিয়া ব্রজমোহনবাবু তাহার বেহানের ঘরকন্না তুলিয়া লইবার ব্যবস্থা করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। বিবাহের পর সকলে মিলিয়া একসঙ্গে যাত্রা করাই তাহার ইচ্ছা । এইজন্য তিনি বাড়ি হইতে আত্মীয় স্ত্রীলোক কয়েকজনকে সঙ্গেই আনিয়াছিলেন । বিবাহকালে রমেশ ঠিকমত মন্ত্র আবৃত্তি করিল না, শুভদৃষ্টির সময় চোখ বুজিয়া রহিল, বাসরঘরের হাস্তোংপাত নীরবে নতমুখে সহ করিল, রাত্রে শষ্যাপ্রাস্তে পাশ ফিরিয়া রহিল, প্রত্যুষে বিছানা হইতে উঠিয়া বাহিরে চলিয়া গেল । বিবাহ সম্পন্ন হইলে মেয়ের এক নৌকায়, বৃদ্ধের এক নৌকায়, বর ও বয়স্তগণ আর-এক নৌকায় যাত্রা করিল। অন্য এক নৌকায় রোশনচোঁকির দল যখন-তখন যে-সে রাগিণী যেমন-তেমন করিয়া আলাপ করিতে লাগিল ।