পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/১৯৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ጏ ዓ8 রবীন্দ্র-রচনাবলী ভাড়া করিল এবং নিরুদ্দেশ আত্মীয়দের সন্ধানের জন্য পুলিস নিযুক্ত করিয়া বধূকে লইয়া গৃহে রওনা হইল। গ্রামের ঘাটের কাছে নৌকা পৌছিতেই রমেশ খবর পাইল যে, তাহার পিতার, শাশুড়ীর ও আর কয়েকটি আত্মীয়-বন্ধুর মৃতদেহ নদী হইতে পুলিস উদ্ধার করিয়াছে। জনকয়েক মাল্লা ছাড়া আর যে কেহ বাচিয়াছে, এমন আশা আর কাহারও রহিল না । বাড়িতে রমেশের বৃদ্ধ ঠাকুরমা ছিলেন, তিনি বধূসহ রমেশকে ফিরিতে দেখিয়া উচ্চকলরবে কাদিতে লাগিলেন । পাড়ার যে-সকল বরযাত্র গিয়াছিল, তাহীদেরও ঘরে ঘরে কান্না পড়িয়া গেল। শাখ বাজিল না, হুলুধ্বনি হইল না, কেহ বধূকে বরণ করিয়া লইল না, কেহ তাহার দিকে তাকাইল না মাত্র । শ্ৰাদ্ধশাস্তি শেষ হইবার পরেই রমেশ বধকে লইয়া অন্যত্র যাইবে স্থির করিয়াছিল — কিন্তু পৈতৃক বিষয়সম্পত্তির ব্যবস্থা না করিয়া তাহার শীগ্র নড়িবার জো ছিল না । পরিবারের শোকাতুর স্ত্রীলোকগণ তীর্থবাসের জন্য তাহাকে ধরিয়া পড়িয়াছে, তাহারও বিধান করিতে হইবে । এই-সকল কাজকর্মের অবকাশকালে রমেশ প্রণয়চর্চায় অমনোযোগী ছিল না । যদিও পূর্বে যেমন শুনা গিয়াছিল, বধু তেমন নিতান্ত বালিকা নয়, এমনকি গ্রামের মেয়েরা ইহাকে অধিকবয়স্ক বলিয়া ধিক্কার দিতেছিল, তবু ইহার সহিত কেমন করিয়া যে প্রণয় হইতে পারে, এই বি. এ. পাস-করা ছেলেটি তাহার কোনো পুথির মধ্যে সে-উপদেশ প্রাপ্ত হয় নাই। সে চিরকাল ইহা অসম্ভব এবং অসংগত বলিয়াই জানিত। তবু কোনো বই-পড়া অভিজ্ঞতার সঙ্গে কিছুমাত্র না মিলিলেও, আশ্চর্য এই যে, তাহার উচ্চশিক্ষিত মন ভিতরে-ভিতরে একটি অপরূপ রসে পরিপূর্ণ হইয়া এই ছোটো মেয়েটির দিকে অবনত হইয়া পড়িয়াছিল। সে এই বালিকার মধ্যে কল্পনার দ্বারা তাহার ভবিষ্যং গৃহলক্ষ্মীকে উদ্ভাসিত করিয়া তুলিয়াছে। সেই উপায়ে তাহার স্ত্রী একই কালে বালিকা বধ, তরুণী প্রেয়সী এবং সস্তানদিগের অপ্ৰগলভ মাতা রূপে তাহার ধ্যাননেত্রের সম্মুখে বিচিত্রভাবে বিকশিত হইয়া উঠিয়াছে। চিত্রকর তাহার ভাবী চিত্রকে, কবি তাহার ভাবী কাব্যকে যেরূপ সম্পূর্ণ সুন্দরব্রুপে কল্পনা করিয়া হৃদয়ের মধ্যে একাস্ত আদরে লালন করিতে থাকে, রমেশ সেইরূপ এই ক্ষুদ্র বালিকাকে উপলক্ষমাত্র করিয়া ভাবী প্রেয়সীকে কল্যাণীকে পূর্ণমহীয়সী মূর্তিতে হৃদয়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করিল।