পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/১৯৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নৌকাডুবি ›ዓ¢ 6. এইরূপে প্রায় তিন মাস অতীত হইয়া গেল। বৈষয়িক ব্যবস্থা সমস্ত সমাধা হইয়া আসিল । প্রাচীনারা তীর্থবাসের জন্য প্রস্তুত হইলেন। প্রতিবেশীমহল হইতে দুই-একটি সঙ্গিনী নববধূর সহিত পরিচয়স্থাপনের জন্য অগ্রসর হইতে লাগিল । রমেশের সঙ্গে বালিকার প্রণয়ের প্রথম গ্রস্থি অল্পে অল্পে আঁট হইয়া আসিল । এপন সন্ধ্যাবেলায় নির্জন ছাদে খোলা আকাশের তলে দুজনে মাদুর পাতিয়া বসিতে আরম্ভ করিয়াছে । রমেশ পিছন হইতে হঠাৎ বালিকার চোখ টিপিয়া ধরে, তাহার মাথাটা বুকের কাছে টানিয়া আনে, বধু যখন রাত্রি অধিক না হইতেই না থাইয়া ঘুমাইয় পড়ে, রমেশ তখন নানাবিধ উপত্রবে তাহাকে সচেতন করিয়া তাহার বিরক্তি-তিরস্কার লাভ করে । এক দিন সন্ধ্যাবেলায় রমেশ বালিকার খোপা ধরিয়া নাড়া দিয়া কহিল, “সুশীলা, আজ তোমার চুলবাধা ভালো হয় নাই ।” বালিকা বলিয়া বসিল, “আচ্ছা, তোমরা সকলেই আমাকে সুশীলা বলিয়। ডাক কেন ?” রমেশ এ প্রশ্নের তাৎপর্য কিছুই বুঝিতে না পারিয়া অবাক হইয়া তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। বধু কহিল, “আমার নাম বদল হইলেই কি আমার পয় ফিরিবে ? আমি তো শিশুকাল হইতেই অপয়মস্ত— ন মরিলে আমার অলক্ষণ ঘুচিবে না।” হঠাৎ রমেশের বুক ধক করিয়া উঠিল, তাহার মুখ পাণ্ডুবর্ণ হইয়া গেল— কোথায় কী-একটা প্রমাদ ঘটিয়াছে, এ সংশয় হঠাৎ তাহার মনে জাগিয়া উঠিল । রমেশ জিজ্ঞাসা করিল, “শিশুকাল হইতেই তুমি অপয়মস্ত কিসে হইলে ?” বধু কহিল, “আমার জন্মের পূর্বেই আমার বাবা মরিয়াছেন, আমাকে জন্মদান করিয়া তাহার ছয় মাসের মধ্যে আমার মা মারা গেছেন । মামার বাড়িতে অনেক কষ্টে ছিলাম। হঠাৎ শুনিলাম, কোথা হইতে আসিয়া তুমি আমাকে পছন্দ করিলে— দুই দিনের মধ্যেই বিবাহ হইয়া গেল, তার পরে দেখো, কী সব বিপদই ঘটিল।” রমেশ নিশ্চল হইয়া তাকিয়ার উপরে শুইয়া পড়িল । আকাশে চাদ উঠিয়াছিল, তাহার জ্যোৎস্না কালি হইয়া গেল। রমেশের দ্বিতীয় প্রশ্ন করিতে ভয় হইতে লাগিল। যতটুকু জানিয়া ফেলিয়াছে, সেটুকুকে সে প্রলাপ বলিয়া, স্বপ্ন বলিয়া স্থদুরে ঠেলিয়া রাখিতে চায়। সংজ্ঞাপ্রাপ্ত মূৰ্ছিতের দীর্ঘশ্বাসের মতো গ্রীষ্মের দক্ষিণ হাওয়া বহিতে লাগিল। জ্যোৎস্নালোকে নিদ্রাহীন কোকিল ডাকিতেছে— অদূরে