পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/১৯৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নৌকাডুবি ❖ ግo সে লিখিল— ধোবাপুকুর। এইরূপে নানা উপায়ে অত্যন্ত সাবধানে রমেশ এই বালিকার যেটুকু জীবনবৃত্তাস্ত আবিষ্কার করিল তাহাতে বড়ো-একটা স্থবিধা হইল না। তাহার পরে রমেশ কর্তব্য সম্বন্ধে ভাবিতে বসিয়া গেল। খুব সম্ভব, ইহার স্বামী ডুবিয়া মরিয়াছে। যদি-বা শ্বশুরবাড়ির সন্ধান পাওয়া যায়, সেখানে পাঠাইলে তাহারা ইহাকে গ্রহণ করিবে কি না, সন্দেহ। মামার বাড়ি পাঠাইতে গেলেও ইহার প্রতি স্তায়াচরণ করা হইবে না। এতকাল বধুভাবে অন্যের বাড়িতে বাস করার পর আজ যদি প্রকৃত অবস্থা প্রকাশ করা যায়, তবে সমাজে ইহার কী গতি হইবে, কোথায় ইহার স্থান হইবে ? স্বামী যদি বাচিয়াই থাকে, তবে সে কি ইহাকে গ্রহণ করিতে ইচ্ছা বা সাহস করিবে ? এখন এই মেয়েটিকে ষেখানেই ফেলা হইবে সেখানেই সে অতল সমুদ্রের মধ্যে পড়িবে। ইহাকে স্ত্রী ব্যতীত অস্ত কোনোরূপেই রমেশ নিজের কাছে রাখিতে পারে না, অন্যত্রও কোথাও ইহাকে রাখিবার স্থান নাই। কিন্তু তাই বলিয়া ইহাকে নিজের স্ত্রী বলিয়া গ্রহণ করাও চলে না। রমেশ এই বালিকাটিকে ভবিষ্যতের পটে নানাবর্ণের স্নেহসিক্ত তুলি দ্বারা ফলাইয় যে গৃহলক্ষ্মীর মূর্তি অণকিয়া তুলিতেছিল, তাহ আবার তাড়াতাড়ি মুছিতে হইল। রমেশ আর তাহার গ্রামে থাকিতে পারিল না। কলিকাতায় লোকের ভিড়ের মধ্যে আচ্ছন্ন থাকিয়া একটা কিছু উপায় খুজিয়া পাওয়া যাইবে, এই কথা মনে করিয়া রমেশ কমলাকে লইয়া কলিকাতায় আসিল এবং পূর্বে যেখানে ছিল, সেখান হইতে দূরে নূতন এক বাসা ভাড়া করিল। কলিকাতা দেখিবার জন্ত কমলার আগ্রহের সীমা ছিল না। প্রথম দিন বাসার মধ্যে প্রবেশ করিয়া সে জানলায় গিয়া বসিল— সেখান হইতে জনস্রোতের অবিভ্রাম প্রবাহে তাহার মনকে নূতন নূতন কৌতুহলে ব্যাপৃত করিয়া রাখিল । ঘরে এক জন ঝি ছিল, কলিকাতা তাহার পক্ষে অত্যন্ত পুরাতন। সে বালিকার বিস্ময়কে নিরর্থক মূঢ়তা জ্ঞান করিয়া বিরক্ত হইয়া বলিতে লাগিল, “হাগ, স্থা করিয়া কী দেখিতেছ? বেলা যে অনেক হইল, চান করিবে না ?” ঝি দিনের বেলায় কাজ করিয়া রাত্রে বাড়ি চলিয়া যাইবে । রাত্রে থাকিবে, এমন লোক পাওয়া গেল না। রমেশ ভাবিতে লাগিল, "কমলাকে এখন তো এক শয্যায় আর রাখিতে পারি না— অপরিচিত জায়গায় সে বালিকা একলাই বা কী করিয়া রাত কাটাইবে ?