পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২০৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নৌকাডুবি Sbrat লাগে ? যাহাদের সময় কাটাইবার আর কোনো সদুপায় নাই, তাহদের পক্ষেই ইহা ভালো।” হেমনলিনী কোনো উত্তর না দিয়া ঈষৎ হাস্তমুখে ছুচে রেশম পরাইতে থাকে। অক্ষয় তীব্রস্বরে বলে, "যে-সকল কাজ সংসারের কোনো প্রয়োজনে লাগে, রমেশবাবুর বিধানমতে সে-সমস্ত তুচ্ছ। মশায় যত-বড়োই তত্ত্বজ্ঞানী এবং কবি হ’ন না কেন, তুচ্ছকে বাদ দিয়া এক দিনও চলে না।” রমেশ উত্তেজিত হইয়া ইহার . বিরুদ্ধে তর্ক করিবার জন্য কোমর বাধিয়া বসে ; হেমনলিনী বাধা দিয়া বলে, “রমেশবাবু, আপনি সকল কথারই উত্তর দিবার জন্য এত ব্যস্ত হন কেন ? ইহাতে সংসারে অনাবশ্বক কথা যে কত বাড়িয়া যায়, তাহার ঠিক নাই।” এই ৰলিয়া সে মাথা নিচু করিয়া ঘর গনিয়া সাবধানে রেশমস্বত্র চালাইতে প্রবৃত্ত হয়। এক দিন সকালে রমেশ তাহার পড়িবার ঘরে আসিয়া দেখে, টেবিলের উপর রেশমের ফুলকাটা মখমলে বাধানো একটি ব্লটিং-বহি সাজানো রহিয়াছে। তাহার একটি কোণে "র” অক্ষর লেখা আছে, আর-এক কোণে সোনালি জরি দিয়া একটি পদ্ম আঁকা। বইখানির ইতিহাস ও তাৎপর্য বুঝিতে রমেশের ক্ষণমাত্রও বিলম্ব হইল না। তাহার বুক নাচিয়া উঠিল। সেলাই জিনিসটা তুচ্ছ নহে, তাহা তাহার অন্তরাত্মা বিনা তর্কে, বিনা প্রতিবাদে স্বীকার করিয়া লইল। ব্লটিং-বইটা বুকে চাপিয়া ধরিয়া সে অক্ষয়ের কাছেও হার মানিতে রাজি হইল। সেই ব্লটিং-বই খুলিয়া তখনি তাহার উপরে একখানি চিঠির কাগজ রাখিয়া সে লিখিল, “আমি যদি কবি হইতাম, তবে কবিতা লিখিয়া প্রতিদান দিতাম, কিন্তু প্রতিভা হইতে আমি বঞ্চিত। ঈশ্বর আমাকে দিবার ক্ষমতা দেন নাই, কিন্তু লইবার ক্ষমতাও একটা ক্ষমতা। আশাতীত উপহার আমি ষে কেমন করিয়া গ্রহণ করিলাম, অন্তর্যামী ছাড়া তাহা অার কেহ জানিতে পারিবে না। দান চোখে দেখা যায়, কিন্তু আদান হৃদয়ের ভিতরে লুকানো। ইতি। চিরঞ্চণী ।” এই লিখনটুকু হেমনলিনীর হাতে পড়িল। তাহার পরে এ সম্বন্ধে উভয়ের মধ্যে আর কোনো কথাই হইল না। বর্ষাকাল ঘনাইয়া আসিল। বৰ্ষাঋতুটা মোটের উপরে শহুরে মহন্তসমাজের পক্ষে তেমন সুখকর নহে— ওটা আরণ্যপ্রকৃতিরই বিশেষ উপযোগী ; শহরের বাড়িগুলা তাহার রুদ্ধ বাতায়ন ও ছাদ লইয়া, পথিক তাহার ছাতা লইয়া, ট্রামগাড়ি তাহার পর্দা লইয়া, বর্ষাকে কেবল নিযেধ করিবার চেষ্টায় ক্লেদাক্ত পন্ধিল হইয়া উঠিতেছে। নদী-পৰ্বত-অরণ্য-প্রাস্তুর বর্ষাকে সাদর কলরবে বন্ধু বলিয়া আহবান করে। সেইখানেই