পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৪৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নৌকাডুবি t ૨૨૭ আবার রমেশ মনে মনে ভাবিতে লাগিল, "কী করা যাইবে ? এ দিকে রমেশের বুকের ভিতরে বরাবর একটা চাপা বেদন কীটের মতে যেন গহবর খনন করিয়া বাহির হইয়া আসিবার চেষ্টা করিতেছিল। এতক্ষণে যোগেন্দ্র হেমনলিনীকে কী বলিল, হেমনলিনী কী মনে করিতেছে, প্রকৃত অবস্থা কেমন করিয়া হেমনলিনীকে বুঝাইবে, হেমনলিনীর সহিত চিরকালের জন্ত যদি তাহাকে বিচ্ছিন্ন হইতে হয়, তবে জীবন বহন করিবে কী করিয়া– এই-সকল জালাময় প্রশ্ন ভিতরে-ভিতরে জমা হইয়া উঠিতেছিল, অথচ ভালো করিয়া তাহা আলোচনা করিবার অবসর রমেশ পাইতেছিল না। রমেশ এটুকু বুঝিয়াছিল যে, কমলার সহিত রমেশের সম্বন্ধ কলিকাতায় তাহার বন্ধু ও শক্ৰ -মণ্ডলীর মধ্যে তীব্র আলোচনার বিষয় হইয়া উঠিল । রমেশ ষে কমলার স্বামী, এই গোলমালে সেই জনশ্রুতি যথেষ্ট ব্যাপ্ত হইতে থাকিবে । এ সময়ে রমেশের পক্ষে কমলাকে লইয়া আর এক দিনও কলিকাতায় থাকা সংগত হইবে না । অন্যমনস্ক রমেশের এই চিস্তার মাঝখানে হঠাৎ কমলা তাহার মুখের দিকে চাহিয়া কহিল, “তুমি কী ভাবিতেছ ? তুমি যদি দেশে থাকিতে চাও, আমি সেইখানেই থাকিব ।” বালিকার মুখে এই আত্মসংযমের কথা শুনিয়া রমেশের বুকে আবার ঘা লাগিল ; আবার সে ভাবিল, "কী করা যাইবে ? পুনর্বার সে অন্তমনস্ক হইয়া ভাবিতে ভাবিতে নিরুত্তরে কমলার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। কমলা মুখ গভীর করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “আচ্ছা, আমি ছুটির সময়ে ইস্কুলে থাকিতে চাহি নাই বলিয়া তুমি রাগ করিয়াছ ? সত্য করিয়া বলে ।” রমেশ কহিল “সত্য করিয়াই বলিতেছি, তোমার উপরে রাগ করি নাই, আমি নিজের উপরেই রাগ করিয়াছি।” রমেশ ভাবনার জাল হইতে নিজেকে জোর করিয়া ছাড়াইয়া লইয়া কমলার সহিত আলাপ করিতে প্রবৃত্ত হইল। তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “আচ্ছা কমলা, ইস্কুলে এতদিন কী শিখিলে বলো দেখি ।” কমলা অত্যস্ত উৎসাহের সহিত নিজের শিক্ষার হিসাব দিতে লাগিল। সম্প্রতি পৃথিবীর গোলাকৃতির কথা তাহার অগোচর নাই জানাইয়া যখন সে রমেশকে চমৎকৃত করিয়া দিবার চেষ্টা করিল, রমেশ গভীরমুখে ভূমণ্ডলের গোলৰে সন্দেহ প্রকাশ করিল। কহিল, "এ কি কখনো সম্ভব হইতে পারে ?” কমলা চক্ষু বিষ্কারিত করিয়া কহিল, “বা আমাদের বইয়ে লেখা আছে - আমরা পড়িয়াছি।”