পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৪৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ミ&b* রবীন্দ্র-রচনাবলী ছই হাতে চৌকির হাত চাপিয়া ধরিবার চেষ্টা করিতেছে। মুহূর্তকাল পরেই সন্মুখের দিকে ঝুঁকিয়া-পড়িয়া মূৰ্ছিত হইয়া চৌকি হইতে সে নীচে পড়িয়া গেল । অন্নদাবাৰু ব্যাকুল হইয়া পড়িলেন। তিনি ভূলুষ্ঠিত হেমনলিনীর মাথা দুই হাতে বুকের কাছে তুলিয়া লইয়া কহিলেন, “ম, কী হইল মা! ওদের কথা তুমি কিছুই বিশ্বাস করিয়ো না— সব মিথ্যা।” যোগেন্দ্র তাহার পিতাকে সরাইয়া তাড়াতাড়ি হেমনলিনীকে একটা সোফার উপর তুলিল ; নিকটে কুঁজায় জল ছিল, সেই জল লইয়া তাহার মুখে-চোখে বারংবার ছিটাইয় দিল, এবং অক্ষয় একখানা হাতপাখা লইয়া তাহাকে বেগে বাতাস করিতে লাগিল । হেমনলিনী অনতিকাল পরে চোখ খুলিয়াই চমকিয়া উঠিল ; অন্নদাবাবুর দিকে চাহিয়া চীৎকার করিয়া বলিল, “বাব, বাবা, অক্ষয়বাবুকে এখান হইতে সরিয়া যাইতে বলো ।” অক্ষয় পাখা রাখিয়া ঘরের বাহিরে দরজার আড়ালে গিয়া দাড়াইল । অন্নদাবাবু সোফার উপরে হেমনলিনীর পাশে বসিয়া তাহার মুখে-গায়ে হাত বুলাইতে লাগিলেন, এবং গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া কেবল একবার বলিলেন, “মা ।” দেখিতে দেখিতে হেমনলিনীর দুই চক্ষু দিয়া জল ঝরিয়া পড়িতে লাগিল ; তাহার বুক ফুলিয়া ফুলিয়া উঠিল ; পিতার জামুর উপর বুক চাপিয়া ধরিয়া তাহার অসহ রোদনের বেগ সংবরণ করিতে চেষ্টা করিল। অন্নদাবাবু অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলিতে লাগিলেন, “ম, তুমি নিশ্চিন্ত থাকো মা। রমেশকে আমি খুব জানি— সে কখনোই অবিশ্বাসী নয়, যোগেন নিশ্চয়ই ভুল করিয়াছে।” যোগেন্দ্র আর থাকিতে পারিল না ; কহিল, “বাবা, মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে না। এখনকার মতো কষ্ট বাচাইতে গিয়া উহাকে দ্বিগুণ কষ্টে ফেলা হইবে । বাবা, হেমকে এখন কিছুক্ষণ ভাবিবার সময় দাও।” হেমনলিনী তখনি পিতার জাহ ছাড়িয়া উঠিয়া বসিল, এবং যোগেঞ্জের মুখের দিকে চাহিয়া কহিল, “আমার যাহা ভাবিবার, সব ভাবিয়াছি। যতক্ষণ র্তাহার নিজের মুখ হইতে না শুনিব, ততক্ষণ আমি কোনোমতেই বিশ্বাস করিব না, ইহা নিশ্চয় জানিয়ো ।” এই কথা বলিয়া সে উঠিয়া পড়িল। অন্নদাবাবু ব্যস্ত হইয় তাহাকে ধরিলেন ; কহিলেন, “পড়িয়া যাইবে।” হেমনলিনী অন্নদাবাবুর হাত ধরিয়া তাহার শেবার ঘরে গেল। বিছানায় শুইয়া কহিল, “বাবা, আমাকে একটুখানি একলা রাখিয়া যাও, আমি ঘুমাইব ।”