পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৫১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নৌকাডুবি ২৩১ বালিকা বিছানায় শুইয়া যতক্ষণ না ঘুম আসিল, মাঝে মাঝে খিল খিল করিয়া হাসিয়া উঠিল। কিন্তু এই ব্যাপারে রমেশের বিশেষ কৌতুকবোধ হইল না। রমেশ জানিত, কোনো পল্লিগ্রামের সহিত অক্ষয়ের কোনো সম্বন্ধ ছিল না ; সে পুরুষানুক্রমে কলিকাতাবাসী ; আজ রাত্রে এমন উর্ধ্বশ্বাসে সে কলিকাতা ছাড়িয়া কোথায় যাইতেছে ? রমেশ নিশ্চয় বুঝিল, অক্ষয় তাহারই অনুসরণে চলিয়াছে। অক্ষয় যদি তাহাদের গ্রামে গিয়া অনুসন্ধান আরম্ভ করে এবং সেখানে রমেশের স্বপক্ষবিপক্ষমণ্ডলীর মধ্যে এই কথা লইয়া একটা ঘাটাঘাটি হইতে থাকে, তবে সমস্ত ব্যাপারটা কিরূপ জঘন্য হইয়া উঠিবে, তাহাই কল্পনা করিয়া রমেশের হৃদয় অশাস্ত হইয়া উঠিল। তাহাদের পাড়ায় কে কী বলিবে, কিরূপ ঘোট চলিবে, তাহ রমেশ যেন প্রত্যক্ষবৎ দেখিতে লাগিল। কলিকাতার মতো শহরে সকল অবস্থাতেই অস্তরাল খুজিয়া পাওয়া যায়, কিন্তু ক্ষুদ্র পল্লীর গভীরতা কম বলিয়াই অল্প আঘাতেই তাহার আন্দোলনের ঢেউ উত্তাল হইয়া উঠে । সেই কথা যতই চিন্তা করিতে লাগিল রমেশের মন ততই সংকুচিত হইতে লাগিল । বারাকপুরে যখন গাড়ি থামিল রমেশ মুখ বাড়াইয়া দেখিতে লাগিল, অক্ষয় নামিল না। নৈহাটিতে অনেক লোক উঠানামা করিতে লাগিল, তাহার মধ্যে অক্ষয়কে দেখা গেল না। এক বার বৃথা আশায় বগুলা স্টেশনেও রমেশ ব্যগ্র হইয়া মুখ বাড়াইল —অবরোহীদের মধ্যে অক্ষয়ের চিহ্ন নাই। তাহার পরের আর-কোনো স্টেশনে অক্ষয়ের নামিবার কোনো সম্ভাবনা সে কল্পনা করিতে পারিল না। অনেক রাত্রে শ্রাস্ত হইয়। রমেশ ঘুমাইয়া পড়িল । পরদিন প্রাতে গোয়ালন্দে গাড়ি পৌছিলে রমেশ দেখিল, অক্ষয় মাথায় মুখে চাদর জড়াইয়া একটা হাতব্যাগ লইয়া তাড়াতাড়ি সুমারের দিকে ছুটিয়া চলিয়াছে। যে মারে রমেশের উঠিবার কথা সে স্কীমার ছাড়িবার এখনো বিলম্ব আছে। কিন্তু অন্ত ঘাটে আর-একটা স্টীমার গমনোন্মুখ অবস্থায় ঘন ঘন বঁাশি বাজাইতেছে। রমেশ জিজ্ঞাসা করিল, “এ স্টীমার কোথায় যাইবে ?” উত্তর পাইল, “পশ্চিমে।” “কতদূর পর্যন্ত যাইবে ?” "জল না কমিলে কাশী পর্যন্ত যায়।” শুনিয়া রমেশ তৎক্ষণাৎ সেই স্ট্রীমারে উঠিয়া কমলাকে একটা কামরায় বসাইয়া আসিল এবং তাড়াতাড়ি কিছু দুধ চাল-ডাল এবং এক ছড়া কলা কিনিয়া লইল ।