পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৫৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

২৩৪ রবীন্দ্র-রচনাবলী করিলেন। আজ তাহার কপোল পাণ্ডুবৰ্ণ, তাহার চোখের নীচে কালী পড়িয়া গেছে। ঘরে ঢুকিয় সে চোখ নিচু করিল যোগেন্দ্রের মুখের দিকে চাহিতে পারিল না । সে জানিত, যোগেন্দ্র তাহার ও রমেশের উপর রাগ করিয়াছে, তাহীদের বিরুদ্ধে কঠিন বিচার করিতেছে। এইজন্য যোগেন্দ্রের সঙ্গে মুখোমুখি-চোখোচোথি হওয়া তাহার পক্ষে দুরূহ হইয়া উঠিয়াছে। ভালোবাসায় যদিও হেমনলিনীর বিশ্বাসকে আগলাইয়া রাখিয়াছিল, তবু যুক্তিকে একেবারেই ঠেকাইয়া রাখা চলে না। যোগেন্দ্রের সম্মুখে হেমনলিনী কাল আপনার বিশ্বাসের দৃঢ়তা দেখাইয়া চলিয়া গেল। কিন্তু রাত্রের অন্ধকারে শয়নঘরের মধ্যে একলা সেই বল সম্পূর্ণ থাকে না। বস্তুতই প্রথম হইতে রমেশের ব্যবহারের কোনো অর্থ পাওয়া ষায় না। সন্দেহের কারণগুলিকে হেমনলিনী যত প্রাণপণ বলে তাহার বিশ্বাসের দুর্গের মধ্যে ঢুকিতে দেয় না— তাহারা বাহিরে দাড়াইয়া ততই সবলে আঘাত করিতে থাকে। সাংঘাতিক আঘাত হইতে মা যেমন ছেলেকে বুকের মধ্যে দুই হাতে চাপিয়া ধরিয়া রক্ষা করে, রমেশের প্রতি বিশ্বাসকে হেমনলিনী সমস্ত প্রমাণের বিরুদ্ধে তেমনি জোর করিয়া হৃদয়ে অঁাকড়িয়া রাখিল । কিন্তু হায়, জোর কি সকল সময় সমান থাকে ? হেমনলিনীর পাশের ঘরেই রাত্রে অন্নদাবাবু শুইয়াছিলেন। হেম যে বিছানায় এপাশ-ওপাশ করিতেছিল, তাহা তিনি বুঝিতে পারিতেছিলেন। এক-এক বার তাহার ঘরে গিয়া তাহাকে বলিতেছিলেন, “ম, তোমার ঘুম হইতেছে না ?” হেমনলিনী উত্তর দিতেছিল, “বাবা, তুমি কেন জাগিয়া আছ ? আমার ঘুম আসিতেছে, আমি এখনি ঘুমাইয়া পড়িব ।” পরের দিন ভোরে উঠিয়া হেমনলিনী ছাদের উপর বেড়াইতেছিল। রমেশের বাসার একটি দরজা একটি জানলাও খোলা নাই । 壟 সূর্ব ক্রমে পূর্বদিকের সৌধশিখরমালার উপরে উঠিয়া পড়িল। হেমনলিনীর কাছে আজিকার এই নূতন-অত্যুদিত দিনটি এমনি শুষ্ক শূন্য, এমনি আশাহীন আনন্দহীন ঠেকিল যে, সে সেই ছাদের এক কোণে বসিয়া পড়িয়া দুই হাতে মুখ ঢাকিয়া কাদিয়া উঠিল। আজ সমস্তদিন কেহই আসিবে না, চায়ের সময় কাহাকেও আশা করিবার নাই, পাশের বাড়িতে কেহ এক জন আছে, এই কল্পনা করিবার স্বখটুকু পর্যন্ত ঘুচিয়া গেছে ।

  • হেম, হেম !” হেমনলিনী তাড়াতাড়ি উঠিয়া চোখ মুছিয়া ফেলিয়া সাড়া দিল, “কী বাবা ”