পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৫৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নৌকাডুবি ২৩৫ অন্নদাবাবু ছাদে উঠিয়া আসিয়া হেমনলিনীর পিঠে হাত বুলাইয়া কহিলেন, “আমার আজ উঠিতে দেরি হইয়া গেছে।” অন্নদাবাবু উৎকণ্ঠায় রাত্রে ঘুমাইতে পারেন নাই, ভোরের দিকে ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলেন। আলো চোখে লাগিতেই উঠিয়া পড়িয়া তাড়াতাড়ি মুখ ধুইয়া হেমনলিনীর খবর লইতে গেলেন। দেখিলেন, ঘরে কেহ নাই। সকালে তাহাকে একলা বেড়াইতে দেখিয়া তাহার বুকের মধ্যে আঘাত লাগিল। কহিলেন, “চলে মা, চা খাইবে চলো।” চায়ের টেবিলে যোগেন্দ্রের সম্মুখে বসিয়া চা খাইবার ইচ্ছ। হেমনলিনীর ছিল না। কিন্তু সে জানিত, কোনোরূপ নিয়মের অন্যথা তাহার বাপকে পীড়া দেয়। তা ছাড়া, প্রত্যহ সে নিজের হাতে তাহার বাপের পেয়ালায় চা ঢালিয়া দেয়, এই সেবাটুকু হইতে সে নিজেকে বঞ্চিত করিতে চাহিল না । 驅 নীচে গিয়া ঘরে পৌছিবার পূর্বে যখন সে বাহির হইতে শুনিল যোগেন্দ্র কাহার সঙ্গে কথা কহিতেছে, তখন তাহার বুক কঁপিয়া উঠিল – হঠাৎ মনে হইল, বুঝি রমেশ আসিয়াছে । এত সকালে আর কে আসিবে ? কম্পিতপদে ঘরে ঢুকিয়া যেই দেখিল অক্ষয়, অমনি সে আর কিছুতেই আত্মসংবরণ করিতে পারিল না— তৎক্ষণাৎ ছুটিয়া বাহির হইয়া আসিল । দ্বিতীয়বার অন্নদাবাবু যখন তাহাকে ঘরের মধ্যে লইয়া আসিলেন, তখন সে তাহার পিতার চৌকির পাশে ঘেষিয়া দাড়াইয়া নতমুখে তাহার চা প্রস্তুত করিয়া দিতে লাগিল । ধোগেন্দ্র হেমনলিনীর ব্যবহারে অত্যন্ত বিরক্ত হইয়াছিল। হেম ষে রমেশের জন্ত এমন করিয়া শোক অনুভব করিবে, ইহা তাহার অসহ বোধ হইতেছিল। তাহার পরে যখন দেখিল, অন্নদাবাবু তাহার এই শোকের সঙ্গী হইয়াছেন এবং সেও যেন সংসারের আর-সকলের নিকট হইতে অন্নদাবাবুর স্নেহচ্ছায়ায় আপনাকে রক্ষা করিতে চেষ্টা করিতেছে, তখন তাহার অধৈর্য আরও বাড়িয়া উঠিল – “আমরা যেন সবাই অন্যায়কারী ! আমরা যে স্নেহের খাতিরেই কর্তব্যপালনে চেষ্টা করিতেছি, আমরাই যে যথার্থভাবে উহার মঙ্গলসাধনে প্রবৃত্ত, তাহার জন্ত লেশমাত্র কৃতজ্ঞতা দূরে থাক, মনে মনে আমাদের দোষী করিতেছে। বাবার তো কোনো বিষয়ে কাগুজ্ঞান নাই। এখন সাম্বনা দিবার সময় নহে, এখন আঘাত দিবারই সময় । তাহা না করিয়া তিনি ক্রমাগতই অপ্রিয় সত্যকে উহার নিকট হইতে দূরে খেদাইয়া রাখিতেছেন।” যোগেজ জয়দাবাবুকে সম্বোধন করিয়া কহিল, "জান বাবা, কী হইয়াছে ?”