পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৬৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

२88 . রবীন্দ্র-রচনাবলী এইরূপে গৃহিণীপনার সমস্ত ভারই আপনা হইতেই কমলার হাতে গিয়া পড়িতেছে, রমেশ তাহা প্রত্যক্ষ করিয়া আবার একবার জাহাজের রেলিং ধরিয়া পশ্চিম-আকাশের দিকে চাহিল। পশ্চিম-আকাশ দেখিতে দেখিতে তাহার চোখের উপরে সম্পূর্ণ অন্ধকার হইয়া আসিল । উমেশ আজ পেট ভরিয়া চিড়ে দই কলা মাখিয়া ফলার করিল। কমলা সম্মুখে দাড়াইয়া তাহার জীবনবৃত্তাস্ত সবিস্তারে আয়ত্ত করিয়া লইল । বিমাতা-শাসিত গৃহের উপেক্ষিত উমেশ কাশীতে তাহার মাতামহীর কাছে পালাইয়া যাইতেছিল ; সে কহিল, “মা, যদি তোমাদের কাছেই রাখ তবে আমি আর কোথাও যাই না।” মাতৃহীন বালকের মুখে মা-সম্ভাষণ শুনিয়া বালিকার কোমল হৃদয়ের কোন-এক গভীরদেশ হইতে জননী সাড়া দিল ; কমলা স্নিগ্ধস্বরে কহিল, “বেশ তো উমেশ, তুই আমাদের সঙ্গেই চল ।” ২৫ তীরের বনরাজি অবিচ্ছিন্ন মসীলেখায় সন্ধ্যাবধূর সোনার অঞ্চলে কালো পাড় টানিয়া দিল । গ্রামাস্তরের বিলের মধ্যে সমস্ত দিন চরিয়া বন্যহংসের দল আকাশের মানায়মান স্বর্যাস্তদীপ্তির মধ্য দিয়া ও পারের তরুশূন্ত বালুচরে নিভৃত জলাশয়গুলিতে রাত্রিযাপনের জন্য চলিয়াছে । কাকেদের বাসায় আসিবার কলরব থামিয়া গেছে । নদীতে তখন নৌকা ছিল না ; একটিমাত্র বড়ো ডিঙি গাঢ় সোনালি-সবুজ নিস্তরঙ্গ জলের উপর দিয়া আপন কালিমা বহিয়া নিঃশব্দে গুণ টানিয়া চলিয়াছিল । রমেশ জাহাজের ছাদের সম্মুখভাগে নবোদিত শুক্লপক্ষের তরুণ চাদের আলোকে বেতের কেদার টানিয়া লইয়া বসিয়া ছিল । পশ্চিম-আকাশ হইতে সন্ধ্যার শেষ স্বর্ণচ্ছায়া মিলাইয়া গেল ; চন্দ্রালোকের ইন্দ্রজালে কঠিন জগৎ যেন বিগলিত হইয়া জাসিল। রমেশ আপনা-আপনি মৃদুস্বরে বলিতে লাগিল, “হেম, হেম!” সেই নামের শব্দটিমাত্ৰ যেন স্বমধুর স্পর্শরূপে তাহার সমস্ত হৃদয়কে বারংবার বেষ্টন করিয়া প্রদক্ষিণ করিয়া ফিরিল ; সেই নামের শব্দটিমাত্র যেন অপরিমেয়করুণরসার্জ দুইটি ছায়াময় চক্ষুরূপে তাহার মুখের উপরে বেদন বিকীর্ণ করিয়া চাহিয়া রহিল। রমেশের সর্বশরীর পুলকিত এবং দুই চক্ষু অশ্রুসিক্ত হুইয়া আসিল ।