পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৭১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নৌকাডুবি SC অপূর্বতার মধ্যে নিমগ্ন হইয়। রমেশ তাহার কর্তব্য-সমস্ত উম্ভেদ করিতে চেষ্টা করিল। রমেশ বুঝিল যে, হেমনলিনী কিংবা কমলা উভয়ের মধ্যে এক জনকে বিসর্জন দিতেই হইবে। উভয়কেই রক্ষা করিয়া চলিবার কোনো মধ্যপথ নাই। তবু হেমনলিনীর আশ্রয় আছে— এখনো হেমনলিনী রমেশকে ভুলিতে পারে, সে আর-কাহাকেও বিবাহ করিতে পারে, কিন্তু কমলাকে ত্যাগ করিলে এ জীবনে তাহার আর-কোনো উপায় নাই । মানুষের স্বার্থপরতার অন্ত নাই। হেমনলিনীর ষে রমেশকে ভুলিবার সম্ভাবনা আছে, তাহার রক্ষার উপায় আছে, রমেশের সম্বন্ধে সে যে অনন্তগতি নহে, ইহাতে রমেশ কোনো সাত্বনা পাইল না ; তাহার আগ্রহের অধীরতা দ্বিগুণ বাড়িয়া উঠিল। মনে হইল, এখনি হেমনলিনী তাহার সম্মুখ দিয়া যেন স্থলিত হইয়া চিরদিনের মতো অনায়ত্ত হইয়া চলিয়া যাইতেছে, এখনো যেন বাহু বাড়াইয় তাহাকে ধরিতে পারা যায়। দুই করতলের উপরে সে মুখ রাখিয়া ভাবিতে লাগিল। দূরে শৃগাল ডাকিল, গ্রামে দুই-একটা অসহিষ্ণু কুকুর খেউ-খেউ করিয়া উঠিল । রমেশ তখন করতল হইতে মুখ তুলিয়া দেখিল, কমলা জনশূন্ত অন্ধকার ডেকের রেলিং ধরিয়া দাড়াইয়া আছে। রমেশ চৌকি ছাড়িয়া উঠিয়া গিয়া কহিল, “কমল, তুমি এখনো শুইতে যাও নাই ? রাত তো কম হয় নাই ।” কমলা কহিল, “তুমি শুইতে যাইবে না ?” রমেশ কহিল, “আমি এখনি যাইব, পুবদিকের কামরায় আমার বিছানা হইয়াছে। তুমি আর দেরি করিয়ো না।” কমলা আর কিছু না বলিয়া ধীরে ধীরে তাহার নির্দিষ্ট কামরায় প্রবেশ করিল। সে আর রমেশকে বলিতে পারিল না যে, কিছুক্ষণ আগেই সে ভূতের গল্প শুনিয়াছে এবং তাহার কামরা নির্জন । রমেশ কমলার অনিচ্ছুক মন্দপদবিক্ষেপে অন্ত:করণে আঘাত পাইল ; কহিল, “ভয় করিয়ো না কমল ; তোমার কামরার পাশেই আমার কামরা— মাঝের দরজা খুলিয়া রাখিব ।” কমলা স্পৰ্ধাভরে তাহার শির একটুখানি উৎক্ষিপ্ত করিয়া কহিল, “আমি ভয় করিব কিসের ?” রমেশ তাহার কামরায় প্রবেশ করিয়া বাতি নিবাইয়া দিয়া শুইয়া পড়িল ; মনে মনে কহিল, কমলাকে পরিত্যাগ করিবার কোনো পথ নাই, অতএব হেলনলিনীকে বিদায়। আজ ইহাই{স্থির হইল, আর দ্বিধা করা চলে না।’