পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৭২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

૨૬૨ রবীন্দ্র-রচনাবলী হেমনলিনীকে বিদায় বলিতে যে জীবন হইতে কতখানি বিদায় তাহ অন্ধকারের মধ্যে শুইয়। রমেশ অনুভব করিতে লাগিল। রমেশ আর বিছানায় চুপ করিয়া থাকিতে পারিল না, উঠিয়া বাহিরে আসিল ; নিশীথিনীর অন্ধকারে এক বার অনুভব করিয়া লইল যে, তাহারই লজ্জা, তাহারই বেদনা অনন্ত দেশ ও অনন্ত কালকে আবৃত করিয়া নাই। আকাশ পূর্ণ করিয়া চিরকালের জ্যোতিলোকসকল স্তব্ধ হইয়া আছে ; রমেশ ও হেমনলিনীর ক্ষুদ্র ইতিহাসটুকু তাহাদিগকে স্পর্শও করিতেছে না ; এই আশ্বিনের নদী তাহার নির্জন বালুতটে প্রফুল্ল কাশবনের তলদেশ দিয়া এমন কত নক্ষত্রালোকিত রজনীতে নিযুপ্ত গ্রামগুলির বনপ্রাস্তচ্ছায়ায় প্রবাহিত হইয়া চলিবে, যখন রমেশের জীবনের সমস্ত ধিক্কার শ্মশানের ভস্মমুষ্টির মধ্যে চিরধৈর্যময়ী ধরণীতে মিশাইয়া চিরদিনের মতো নীরব হইয়া গেছে। পরদিন কমলা যখন ঘুম হইতে জাগিল, তখন ভোর-রাত্রি । চারি দিকে চাহিয়া দেখিল, ঘরে কেহ নাই। মনে পড়িয়া গেল, সে জাহাজে আছে । আস্তে আস্তে উঠিয়া দরজ ফাক করিয়া দেখিল, নিস্তব্ধ জলের উপর সূক্ষ্ম একটুখানি শুভ্র কুয়াশার আচ্ছাদন পড়িয়াছে, অন্ধকার পাণ্ডুবৰ্ণ হইয়া আসিয়াছে এবং পূর্বদিকে তরুশ্রেণীর পশ্চাতের আকাশে স্বর্ণচ্ছটা ফুটিয়া উঠিতেছে। দেখিতে দেখিতে নদীর পাণ্ডুর নীলধারা জেলেডিঙির সাদা-সাদা পালগুলিতে খচিত হইয়া উঠিল। কমলা কোনোমতেই ভাবিয়া পাইল না, তাহার মনের মধ্যে কী একটা গৃঢ় বেদন পীড়ন করিতেছে। শরৎকালের এই শিশিরবাপাস্বর। উষা কেন আজ তাহার আনন্দমূর্তি উদ্‌ঘাটন করিতেছে না ? কেন একটা অশ্রজলের আবেগ বালিকার বুকের ভিতর হইতে কণ্ঠ বাহিয়া চোখের কাছে বার বার আকুল হইয়া উঠিতেছে ? তাহার শ্বশুর নাই, শাশুড়ি নাই, সঙ্গিনী নাই, স্বজন-পরিজন কেহই নাই, এ কথা কাল তো তাহার মনে ছিল না - ইতিমধ্যে কী ঘটিয়াছে যাহাতে আজ তাহার মনে হইতেছে, একলা রমেশমাত্র তাহার সম্পূর্ণ নির্ভরস্থল নহে? কেন মনে হইতেছে, এই বিশ্বভুবন অত্যন্ত বৃহৎ এবং সে বালিকা, অত্যস্ত ক্ষুদ্র ? 劇 কমলা অনেকক্ষণ দরজা ধরিয়া চুপ করিয়া দাড়াইয়া রহিল। নদীর জলপ্রবাহ তরল স্বর্ণস্রোতের মতে জলিতে লাগিল। খালাসির তখন কাজে লাগিয়াছে, এঞ্জিন ধক ধক করিতে আরম্ভ করিয়াছে, নোঙর-তোলা ও জাহাজ-ঠেলাঠেলির শব্দে অকালজাগ্রত শিশুর দল নদীর তীরে ছুটিয়া আসিয়াছে।