পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৯৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নৌকাডুবি ২৭৩ কমলা কথাটা না বুঝিয়া চাহিয়া রহিল। বুদ্ধ কহিলেন, ‘রমেশবাবু তবে কি এখনো বলেন নাই ? তোমাদের যে কাশী যাওয়া স্থির হইয়াছে।” শুনিয়া কমলা হা-না কিছুই বলিল না। কিছুক্ষণ পরে কহিল, “খুড়োমশায়, তুমি পারিবে না ; দাও, তোমার বাক্স আমি সাজাইয়া দিই ।” কাশী যাওয়া সম্বন্ধে কমলার এই ঔদাসীন্তে চক্রবর্তী হৃদয়ের মধ্যে একটা গভীর আঘাত পাইলেন। মনে মনে ভাবিলেন, ‘ভালোই হইতেছে, আমার মতো বয়সে আবার নূতন জাল জড়ানো কেন ? ইতিমধ্যে কাশী যাওয়ার কথা কমলাকে জানাইবার জন্য রমেশ আসিয়া উপস্থিত হইল। কহিল, “আমি তোমাকে খুজিতেছিলাম।” কমলা চক্রবর্তীর কাপড়চোপড় ভাজ করিয়া গুছাইতে লাগিল । রমেশ কহিল, “কমলা, এবার আমাদের গাজিপুরে যাওয়া হইল না ; আমি স্থির করিয়াছি, কাশীতে গিয়া প্র্যাকটিস করিব। তুমি কী বল ?” কমলা চক্রবর্তীর বাক্স হইতে চোখ না তুলিয়া কহিল, "না, আমি গাজিপুরেই যাইব । আমি সমস্ত জিনিসপত্র গুছাইয়া লইয়াছি।” কমলার এই দ্বিধাহীন উত্তরে রমেশ কিছু আশ্চর্য হইয়া গেল ; কহিল, “তুমি কি একলাই যাইবে না কি !” কমলা চক্রবর্তীর মুখের দিকে তাহার স্নিগ্ধ চক্ষু তুলিয়া কহিল, "কেন, সেখানে তো খুড়োমশায় আছেন।” কমলার এই কথায় চক্রবর্তী কুষ্ঠিত হইয়া পড়িলেন ; কহিলেন, “ম, তুমি যদি সস্তানের প্রতি এতদূর পক্ষপাত দেখাও, তাহা হইলে রমেশবাবু আমাকে দু চক্ষে দেখিতে পারিবেন না ।” ইহার উত্তরে কমলা কেবল কহিল, “আমি গাজিপুরে যাইব ।” এ সম্বন্ধে যে কাহারও কোনো সম্মতির অপেক্ষা আছে, কমলার কণ্ঠস্বরে এরূপ প্রকাশ পাইল না। রমেশ কহিল, "খুড়ে, তবে গাজিপুরই স্থির।” ঝড়জলের পর সেদিন রাত্রে জ্যোৎস্না পরিষ্কার হইয়া ফুটিয়াছে। রমেশ ডেকের কেদারায় বসিয়া ভাবিতে লাগিল, এমন করিয়া আর চলিবে না। ক্রমেই বিদ্রোহী কমলাকে লইয়া জীবনের সমস্ত৷ অত্যন্ত দুরূহ হইয়া উঠিবে। এমন করিয়া কাছে থাকিয়া দূরত্ব রক্ষা করা দুরূহ। এবারে হাল ছাড়িয়া দিব। কমলাই আমার স্ত্রী— আমি তো উহাকে স্ত্রী বলিয়াই গ্রহণ করিয়াছিলাম। মন্ত্র পড়া হয় নাই বলিয়াই