পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৩৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

|రిన 6 রবীন্দ্র-রচনাবলী তথাপি তিনি মনে মনে একটু খুশি হইলেন। তিনি ভাবিলেন, হেম যদি জোর করিয়াও এইরূপ মেলামেশা যাওয়া-আসা করিতে থাকে তাহা হইলে শীঘ্র উহার মন স্বস্থ হইবে। মানুষের সহবাসই মানুষের সর্বপ্রকার মনোবৈকল্যের প্রধান ঔষধ। তিনি কহিলেন, “তা, বেশ তো যোগেন্দ্র, কাল যথাসময়ে আমাদের মিটিঙে লইয়া যাইয়ো । কিন্তু নলিনাক্ষ সম্বন্ধে কী জান, বলে তো । অনেক লোকে তো অনেক কথা কয় ।” যে অনেক লোকে অনেক কথা বলিয়া থাকে প্রথমতঃ যোগেন্দ্র তাহাদিগকে খুব একচেটি গালি দিয়া লইল । বলিল, “ধৰ্ম লইয়া যাহারা ভড়ং করে, তাহারা মনে করে, কথায় কথায় পরের প্রতি অবিচার ও পরনিন্দ করিবার জন্য তাহারা ভগবানের স্বাক্ষরিত দলিল লইয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছে ; ধর্মব্যবসায়ীদের মতো এতবড়ো সংকীর্ণচিত্ত বিশ্বনিন্দুক আর জগতে নাই।” বলিতে বলিতে যোগেন্দ্র অত্যন্ত উত্তেজিত হইয়া উঠিল । অন্নদা যোগেন্দ্রকে ঠাণ্ডা করিবার জন্য বার বার বলিতে লাগিলেন, “সে কথা ঠিক, সে কথা ঠিক । পরের দোষত্রুটি লইয়া কেবলই আলোচনা করিতে থাকিলে মন ছোটো হইয়া যায়, স্বভাব সন্দিগ্ধ হইয় উঠে, হৃদয়ের সরসতা থাকে না।” যোগেন্দ্র কহিল, “বাবা, তুমি কি আমাকে লক্ষ্য করিয়া বলিতেছ ? কিন্তু ধার্মিকের মতো আমার স্বভাব নয় ; আমি মন্দ বলিতেও জানি, ভালো বলিতেও জানি এবং মুখের উপরে স্পষ্ট করিয়া বলিয়া হাতে-হাতেই সব কথা চুকাইয়া ফেলি।” অন্নদা ব্যস্ত হইয়া কহিলেন, “যোগেন, তুমি কি পাগল হইয়াছ ? তোমাকে লক্ষ্য করিয়া বলিব কেন ? আমি কি তোমাকে চিনি না ?” তখন ভূরি ভূরি প্রশংসাবাদের দ্বারা পরিপূর্ণ করিয়া যোগেন্দ্ৰ নলিনাক্ষের বৃত্তাস্ত বিবরিত করিল। কহিল, “মাতাকে সুখী করিবার জন্য নলিনাক্ষ আচার সম্বন্ধে সংযত হইয়া কাশীতে বাস করিতেছে, এই জন্যই, বাবা, তুমি যাহাদিগকে অনেক লোক বল তাহারা অনেক কথা বলিতেছে। কিন্তু আমি তো এজন্য নলিনাক্ষকে ভালোই বলি। হেম, তুমি কী বল ?” হেমনলিনী কহিল, “আমিও তো তাই বলি।” যোগেন্দ্ৰ কহিল, "হেম যে ভালোই বলিবে, তাহা আমি নিশ্চয় জানিতাম । বাবাকে সুখী করিবার জন্য হেম একটা-কিছু ত্যাগস্বীকার করিবার উপলক্ষ পাইলে যেন বঁাচে, তাহা আমি বেশ বুঝিতে পারি।” অন্নদা স্বেহকোমলহাস্তে হেমের মুখের দিকে চাহিলেন— হেমনলিনী লজ্জায় রক্তিম মুখখানি নত করিল।