পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৭৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ややo রবীন্দ্র-রচনাবলী তখন এক-রকম মরিয়া গোছের ছিল ; আমি কিছু চিন্তা না করিয়াই বলিলাম, এ মেয়েটিকে আমিই বিবাহ করিব।” ইহার পূর্বে আমি স্থির করিয়াছিলাম, একটি হিন্দুঘরের মেয়ে বিবাহ করিয়া আনিয়া আমি তোমাকে চমৎকৃত করিয়া দিব ; আমি জানিতাম, বড়ো বয়সের ব্রাহ্মমেয়ে আমাদের এ ঘরে আনিলে তাহাতে সকল পক্ষই অমুখী হইবে । ভূপেন তো একেবারে আশ্চর্য হইয়া গেল । সে বলিল, ‘কী বল ? আমি বলিলাম, বিলাবলি নয়, আমি একেবারেই মন স্থির করিয়াছি।’ ভূপেন কহিল, পাকা ? আমি কহিলাম, পাকা । সেই সন্ধ্যাবেলাতেই স্বয়ং তারিণী চাটুজ্জে আমাদের তাবুতে আসিয়া উপস্থিত। ব্রাহ্মণ হাতে পইতা জড়াইয়া জোড়হাত করিয়া কহিলেন, “আমাকে উদ্ধার করিতেই হইবে । মেয়েটি স্বচক্ষে দেখুন, যদি পছন্দ না হয় তো অন্য কথা— কিন্তু শত্রুপক্ষের কথা শুনিবেন না । আমি বলিলাম, ‘দেখিবার দরকার নাই, দিন স্থির করুন।’ তারিণী কহিলেন, ‘পরশু দিন ভালো আছে, পরশুই হইয়া যাক।’ তাড়াতাড়ির দোহাই দিয়া বিবাহে যথাসাধ্য খরচ বঁাচাইবার ইচ্ছা তাহার ছিল । বিবাহ তো হইয়া গেল।” ক্ষেমংকরী চমকিয়া উঠিয়া কহিলেন, “বিবাহ হইয়া গেল— বল কী নলিন !” নলিনাক্ষ। হা, হইয়া গেল। বন্ধু লইয়া নৌকাতেও উঠিলাম। যেদিন বৈকালে উঠিলাম, সেইদিনই ঘণ্টা-দুয়েক বাদে স্বর্যাস্তের এক দণ্ড পরে হঠাং সেই অকালে ফাল্গুনমাসে কোথা হইতে অত্যন্ত গরম একটা ঘূর্ণিবাতাস আসিয়া এক মুহূর্তে আমাদের নৌকা উলটাইয়া কী করিয়া দিল, কিছু যেন বোঝা গেল না । ক্ষেমংকরী বলিলেন, “মধুসুদন !” তাহার সর্বশরীরে কাটা দিয়া উঠিল। নলিনাক্ষ । ক্ষণকাল পরে যখন বুদ্ধি ফিরিয়া আসিল তখন দেখিলাম, আমি নদীতে এক জায়গায় সীতার দিতেছি, কিন্তু নিকটে কোনো নৌকা বা আরোহীর কোনো চিহ্ন নাই। পুলিসে খবর দিয়া খোজ অনেক করা হইয়াছিল, কিন্তু কোনো ফল হইল না । به ক্ষেমংকরী পাংশুবর্ণ মুখ করিয়া কহিলেন, “যাক, যা হইয়া গেছে তা গেছে, ও কথা আমার কাছে আর কখনো বলিস নে— মনে করিতেই আমার বুক কঁপিয়া উঠিতেছে।” নলিনাক্ষ । এ কথা আমি কোনোদিনই তোমার কাছে বলিতাম না, কিন্তু বিবাহের কথা লইয়া তুমি নিতান্তই জেদ করিতেছ বলিয়াই বলিতে হইল। ক্ষেমংকরী কহিলেন, “এক বার একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়াছিল বলিয়া তুই ইহজীবনে কখনো বিবাহই করিবি না ?”