পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৪৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী উদারনির্মল আলোকের সহিত ব্যাপ্ত করিয়া দিল। একটি গভীর ভক্তি তাহার হৃদয়ের কানায়-কানায় পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল, তাহার অস্তরের পূজা সমস্ত বিশ্বকে ধূপের পুণ্য গন্ধে বেষ্টন করিল। দেখিতে দেখিতে কখন অজ্ঞাতসারে তাহার দুই চক্ষু জলে ভরিয়া আসিল ; বড়ো বড়ো জলের ফোটা তাহার দুই কপোল দিয়া ঝরিয়া পড়িতে লাগিল, আর থামিতে চাহিল না, তাহার অনাথ জীবনের সমস্ত দুঃখের মেঘ আজি আনন্দের জলে ঝরিয়া পড়িল । নলিনাক্ষ তাহাকে আর-কোনো কথা না বলিয়া একবার কেবল দক্ষিণ হস্তে তাহার ললাট হইতে সিক্ত কেশ সরাইয়া দিয়া ঘর হইতে চলিয়া গেল । কমলা তাহার পূজা এখনো শেষ করিতে পারিল না— তাহার পরিপূর্ণ হৃদয়ের ধারা এখনো সে ঢালিতে চায়, তাই সে নলিনাক্ষের শোবার ঘরে গিয়া আপনার গলার মালা দিয়া সেই খড়ম-জোড়াকে জড়াইল এবং তাহা আপনার মাথায় ঠেকাইয়৷ যত্বপূর্বক যথাস্থানে তুলিয়া রাখিল । * তার পরে সমস্ত দিন তাহার গৃহকর্ম যেন দেবসেবার মতো মনে হইতে লাগিল । প্রত্যেক কৰ্মই যেন আকাশে এক-একটি আনন্দের তরঙ্গের মতো উঠিল পড়িল । ক্ষেমংকরী তাহাকে কহিলেন, “ম, তুমি করিতেছ কী ? এক দিনে সমস্ত বাড়িটাকে ধুইয়া মাজিয়া মুছিয়া একেবারে নূতন করিয়া তুলিবে না কি ?” বৈকালের অবকাশের সময় আজ আর সেলাই না করিয়া কমলা তাহার ঘরের মেজের উপরে স্থির হইয়া বসিয়া আছে, এমন সময় নলিনাক্ষ একটি টুকরিতে গুটিকয়েক স্থলপদ্ম লইয়া ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল ; কহিল, "কমলা, এই ফুল কটি তুমি জল দিয়া তাজা করিয়া রাখো, আজ সন্ধ্যার পর আমরা দুজনে মাকে প্ৰণাম করিতে যাইব ।” কমলা মুখ নত করিয়া কহিল, “কিন্তু আমার সব কথা তো শোন নাই।” নলিনাক্ষ কহিল, “তোমাকে কিছু বলিতে হইবে না, আমি সব জানি।” কমলা দক্ষিণ করতল দিয়া মুখ ঢাকিয়া কহিল, “ম কি—” বলিয়া কথা শেষ করিতে পারিল না । নলিনাক্ষ তাহার মুখ হইতে হাত নামাইয়া ধরিয়া কহিল, “মা তাহার জীবনে অনেক অপরাধকে ক্ষমা করিয়া আসিয়াছেন, যাহা অপরাধ নহে তাহাকে তিনি ক্ষমা করিতে পারিবেন।”