পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৬২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিচিত্র প্রবন্ধ 88ዓ হইতে একটি অপূর্বত উড়িয়া আসিয়া জুড়িয়া বসে। পাগলও ইহারই কীর্তি এবং প্রতিভাও ইহারই কীর্তি। ইহার টানে যাহার তার ছিড়িয়া যায় সে হয় উন্মাদ, আর যাহার তার অশ্রুতপূর্ব স্বরে বাজিয়া উঠে সে হইল প্রতিভাবান ! পাগলও দশের বাহিরে, প্রতিভাবানও তাই ; কিন্তু পাগল বাহিরেই থাকিয়া যায়, আর প্রতিভাবান দশকে একাদশের কোঠায় টানিয়া আনিয়া দশের অধিকার বাড়াইয়া দেন । শুধু পাগল নয়, শুধু প্রতিভাবান নয়, আমাদের প্রতিদিনের একরঙা তুচ্ছতার মধ্যে হঠাৎ ভয়ংকর তাহার জলজ্জটাকলাপ লইয়া দেখা দেয়। সেই ভয়ংকর, প্রকৃতির মধ্যে একটা অপ্রত্যাশিত উংপাত, মাতুষের মধ্যে একটা অসাধারণ পাপ আকারে জাগিয়া উঠে । তথন কত স্বথমিলনের জাল লণ্ডভণ্ড, কত হৃদয়ের সম্বন্ধ ছারখার হইয়া যায়। হে রুত্ৰ, তোমার ললাটের যে ধ্বক ধ্বক অগ্নিশিখার ফুলিঙ্গমাত্রে অন্ধকারে গৃহের প্রদীপ জলিয়া উঠে সেই শিখাতেই লোকালয়ে সহস্ত্রের হাহাধ্বনিতে নিশীথরাত্রে গৃহদাহ উপস্থিত হয়। হায়, শস্তৃ, তোমার নৃত্যে তোমার দক্ষিণ ও বাম পদক্ষেপে সংসারে মহাপুণ্য ও মহাপাপ উৎক্ষিপ্ত হইয়া উঠে । সংসারের উপরে প্রতিদিনের জড়হস্তক্ষেপে যে-একটা সামান্যতার একটানা আবরণ পড়িয়া যায়, ভালোমন্দ দুয়েরই প্রবল আঘাতে তুমি তাহাকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করিতে থাক ও প্রাণের প্রবাহকে অপ্রত্যাশিতের উত্তেজনায় ক্রমাগত তরঙ্গিত করিয়া শক্তির নব নব লীলা ও স্বষ্টির নব নব মূর্তি প্রকাশ করিয়া তোল। পাগল, তোমার এই রুদ্র আনন্দে যোগ দিতে আমার ভীত হৃদয় ষেন পরাস্মুখ না হয়। সংহারের রক্ত-আকাশের মাঝখানে তোমার রবিকরোদ্দীপ্ত তৃতীয় নেত্ৰ যেন ধ্রুবজ্যোতিতে আমার অস্তরের অন্তরকে উদ্ভাসিত করিয়া তোলে। নৃত্য করে, হে উন্মাদ, নৃত্য করে। সেই নৃত্যের ঘূর্ণবেগে আকাশের লক্ষকোটিযোজনব্যাপী উজ্জ্বলিত নীহারিক যখন ভ্ৰাম্যমাণ হইতে থাকিবে তখন আমার বক্ষের মধ্যে ভয়ের আক্ষেপে যেন এই রুদ্রসংগীতের তাল কাটিয়া না যায়। হে মৃত্যুঞ্জয়, আমাদের সমস্ত ভালো এবং সমস্ত মন্দের মধ্যে তোমারই জয় হউক । আমাদের এই খ্যাপী দেবতার আবির্ভাব যে ক্ষণে ক্ষণে তাহা নহে ; স্বষ্টির মধ্যে ইহার পাগলামি অহরহ লাগিয়াই আছে, আমরা ক্ষণে ক্ষণে তাহার পরিচয় পাই মাত্র । অহরহই জীবনকে মৃত্যু নবীন করিতেছে, ভালোকে মন্দ উজ্জল করিতেছে, তুচ্ছকে অভাবনীয় মূল্যবান করিতেছে। যখন পরিচয় পাই তখনি রূপের মধ্যে অপরূপ, বন্ধনের মধ্যে মুক্তির প্রকাশ, আমাদের কাছে জাগিয়া উঠে।