পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৮৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিচিত্র প্রবন্ধ 8ፃ » এবং তাহার পাঠকগণের হৃদগহবর হইতে উষ্ণ দীর্ঘশ্বাস ঘন ঘন উচ্ছ্বসিত। আশা করি, শনিগ্রহের অধিবাসীদেরও এমন দশা নয় । তা ছাড়া স্থখও পাইব না অথচ নিন্দাও করিব, এমন ভয়ংকর নিন্দুক মন্থন্তজাতিও নহে। মাহুষকে বিধাতা এতই শৌখিন করিয়া স্থষ্টি করিয়াছেন যে, যখন সে নিজের পেট ভরাইয়া প্রাণরক্ষা করিতে যাইতেছে তখনো ক্ষুধানিবৃত্তি ও রুচিপরিতৃপ্তির যে স্থখ সেটুকুও তাহার চাই– সেই মানুষ ট্রামভাড়া করিয়া বন্ধুর বাড়ি গিয়া পরের নিন্দা করিয়া আসিবে, অথচ তাহাতে মুখ পাইবে না, যে ধর্মনীতি এমন অসম্ভব প্রত্যাশ করে তাহ পূজনীয়, কিন্তু পালনীয় নহে। আবিষ্কারমাত্রেরই মধ্যে মুখের অংশ আছে। শিকার কিছুমাত্র সুখের হইত না, যদি মৃগ যেখানে-সেখানে থাকিত এবং ব্যাধকে দেখিয়া পলাইয়া না যাইত। মৃগের উপরে আমাদের আক্রোশ আছে বলিয়াই যে তাহাকে মারি তাহা নহে, সে বেচারা গহন বনে থাকে এবং সে পলায়নপটু বলিয়া তাহাকে কাজেই মারিতে হয় । মানুষের চরিত্র, বিশেষত তাহার দোষগুলি, ঝোপঝাপের মধ্যেই থাকে এবং পায়ের শব্দ শুনিলেই দৌড় মারিতে চায়, এইজন্যই নিন্দার এত সুখ । আমি নাড়ীনক্ষত্র জানি, আমার কাছে কিছুই গোপন নাই, নিন্দুকের মুখে এ কথা শুনিলেই বোঝা যায়, সে ব্যক্তি জাত শিকারি। তুমি তোমার যে অংশটা দেখাইতে চাও না আমি সেইটাকেই তাড়াইয়া ধরিয়াছি । জলের মাছকে আমি ছিপ ফেলিয়া ধরি, আকাশের পাখিকে বাণ মারিয়া পাড়ি, বনের পশুকে জাল পাতিয়া বাধি— ইহা কত সুখের। যাহা লুকায় তাহাকে বাহির করা, যাহা পালায় তাহাকে বাধা, ইহার জন্যে মানুষ কী না করে। দুর্লভতর প্রতি মানুষের একটা মোহ আছে। সে মনে করে, যাহা স্থলভ তাহ খাটি নহে, যাহা উপরে আছে তাহ আবরণমাত্র, যাহা লুকাইয়া আছে তাহাই আসল । এইজন্যই গোপনের পরিচয় পাইলে সে আর-কিছু বিচার না করিয়া প্রকৃতের পরিচয় পাইলাম বলিয়া হঠাৎ খুশি হইয়া উঠে। এ কথা সে মনে করে না যে, উপরের সত্যের চেয়ে নীচের সত্য যে বেশি সত্য তাহা নহে ; এ কথা তাহাকে বোঝানো শক্ত যে, সত্য যদি বাহিরে থাকে তবুও তাহা সত্য এবং ভিতরে যেটা আছে সেটা যদি সত্য না হয় তবে তাহা অসত্য। এই মোহবশতই কাব্যের সরল সৌন্দর্য অপেক্ষ তাহার গভীর তত্ত্বকে পাঠক অধিক সত্য বলিয়া মনে করিতে ভালোবাসে এবং বিজ্ঞ লোকেরা নিশাচর পাপকে আলোকচর সাধুতার অপেক্ষা বেশি বাস্তব বলিয়া তাহার গুরুত্ব