পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৯৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8ԳԵ রবীন্দ্র-রচনাবলী সমাহিত করিয়া রাখ কেন ? তাহা কেবল অস্বাস্থ্যের কারণ হইয়া উঠে। ছাড়িয়া দাও, তাহাকে যাইতে দাও– জীবনমৃত্যুর প্রবাহ রোধ করিয়ে না। হৃদয়ের দুই দ্বারই সমান খুলিয়া রাখে। প্রবেশের দ্বার দিয়া সকলে প্রবেশ করুক, প্রস্থানের দ্বার দিয়া সকলে প্রস্থান করিবে । গৃহ দুই দ্বারই রুদ্ধ করিয়া রাখিয়াছে। যেদিন দ্বার প্রথম রুদ্ধ হইল সেইদিনকার পুরাতন অন্ধকার আজও গৃহের মধ্যে একলা জাগিয়া আছে। গৃহের বাহিরে দিনের পর দিন, রাত্রির পর রাত্রি আসিতেছে ; গৃহের মধ্যে কেবল সেই একটি দিনই বসিয়া আছে। সময় সেখানে চারিটি ভিত্তির মধ্যেই রুদ্ধ। পুরাতন কোথাও থাকে না, এই ঘরের মধ্যে আছে । k এই গৃহের অন্তরে বাহিরে সম্পূর্ণ বিচ্ছেদ হইয়াছে। বাহিরের বার্তা অস্তরে পৌছায় না, অস্তরের নিশ্বাস বাহিরে আসিতে পায় না। জগতের প্রবাহ এই ঘরের দুই পাশ দিয়া বহিয়া যায়। এই গৃহ যেন বিশ্বের সহিত নাড়ির বন্ধন ছেদন করিয়াছে। দ্বার রুদ্ধ করিয়া গৃহ পথের দিকে চাহিয়া আছে। যখন পূর্ণিমার চাদের আলো তাহার দ্বারের কাছে হত্যা দিয়া পড়িয়া থাকে তখন তাহার দ্বার খুলিব-খুলিব করে কিনা কে বলিতে পারে। পাশের ঘরে যখন উংসবের আনন্দধ্বনি উঠে তখন কি তাহার অন্ধকার ছুটিয়া যাইতে চায় না ? এ ঘর কী ভাবে চাহে, কী ভাবে শোনে, আমরা কিছুই বুঝিতে পারি না। ছেলেরা যে একদিন এই ঘরের মধ্যে খেলা করিত, সেই কোলাহলময় দিন এই গৃহের নিশীথিনীর মধ্যে পড়িয়া আজ কাদিতেছে। এই গৃহের মধ্যে যে-সকল স্নেহপ্রেমের লীলা হইয়া গিয়াছে সেই স্নেহ-প্রেমের উপর সহসা কপাট পড়িয়া গেছে— এই নিস্তব্ধ গৃহের বাহিরে দাড়াইয়া আমি তাহাদের ক্ৰন্দন শুনিতেছি । স্নেহ-প্রেম বদ্ধ করিয়া রাখিবার জন্য হয় নাই। মানুষের কাছ হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া লইয়া তাহাকে গোর দিয়া রাখিবার জন্ত হয় নাই। তাহাকে জোর করিয়া বাধিয়া রাখিলে সংসারক্ষেত্রের জন্ত সে র্কাদে । তবে এ গৃহ রুদ্ধ রাখিয়ে না, দ্বার খুলিয়া দাও । স্বর্ষের আলো দেখিয়া, মানুষের সাড়া পাইয়া, চকিত হইয়া ভয় প্রস্থান করিবে। স্থখ এবং দুঃখ, শোক এবং উৎসব, জন্ম এবং মৃত্যু পবিত্র সমীরণের মতো ইহার বাতায়নের মধ্যে দিয়া চিরদিন যাতায়াত করিতে থাকিবে । সমস্ত জগতের সহিত ইহার যোগ হইয়া বাইবে। আশ্বিন-কাতিক ১২৯২ x