পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫১১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8ぬや রবীন্দ্র-রচনাবলী আকাশে তারা উঠিল, দক্ষিনে বাতাস বহিতে লাগিল। খালাসিদের নমাজ পড়া শেষ হইয়া গিয়াছে। একজন খ্যাপা খালাসি তাহার তারের যন্ত্র বাজাইয়া, এক মাথা কোকড়া-ঝাঁকড়া চুল নাড়াইয়া, পরম উৎসাহে গান গাহিতেছে। ছাতের উপরে বিছানায় যে যেখানে পাইলাম শুইয়া পড়িলাম ; মাঝে মাঝে এক-একটি অপরিস্ফুট হাই ও স্বপরিস্ফুট নাসাধ্বনি শ্রুতিগোচর হইতে লাগিল। বাক্যালাপ বন্ধ। মনে হইল যেন একটা বৃহৎ দুঃস্বপ্ন-পক্ষী আমাদের উপরে নিস্তব্ধভাবে চাপিয়া আমাদের কয়জনকে কয়টা ডিমের মতো তা দিতেছে । আমি আর থাকিতে পারিলাম না। আমার মনে হইতে লাগিল মধুরেণ সমাপয়েৎ’। যদি এমনই হয়, কোনো সুযোগে যদি একেবারে কুষ্ঠির শেষ কোঠায় আসিয়া পড়িয়া থাকি, যদি জাহাজ "ঠিক বৈতরণীর পরপারের ঘাটে গিয়াই থামে, তবে বাজনা বাজাইয়া দাও— চিত্রগুপ্তের মজলিসে হাড়িমুখ লইয়া যেন বেরসিকের মতো দেখিতে না হই। আর, যদি সে জায়গাটা অন্ধকারই হয় তবে এখান হইতে অন্ধকার সঙ্গে করিয়া রানীগঞ্জে কয়লা বহিয়া লইয়া যাইবার বিড়ম্বন কেন ? তবে বাজাও । আমার ভ্রাতু-পুত্রটি সেতারে ঝংকার দিল। ঝিনি ঝিনি ঝিন্‌ ঝিন ইমনকল্যাণ বাজিতে লাগিল । তাহার পরদিন অনুসন্ধান করিয়া অবগত হওয়া গেল, জাহাজের এটা ওটা সেটা অনেক জিনিসেরই অভাব। সেগুলি না থাকিলেও জাহাজ চলে বটে কিন্তু যাত্রীদের আবখ্যক বুঝিয়া চলে না, নিজের খেয়ালেই চলে। কলিকাতা হইতে জাহাজের সরঞ্জাম আনিবার জন্য লোক পাঠাইতে হইল । এখন কিছুদিন এইখানেই স্থিতি । গঙ্গার মাঝে মাঝে এক-একবার না দাড়াইলে গঙ্গার মাধুরী তেমন উপভোগ করা যায় না। কারণ, নদীর একটি প্রধান সৌন্দর্য গতির সৌন্দর্ধ। চারি দিকে মধুর চঞ্চলত, জোয়ার-ভাটার আনাগোনা, তরঙ্গের উত্থান-পতন, জলের উপর ছায়ালোকের উংসব-— গঙ্গার মাঝখানে একবার স্থির হইয়া না দাড়াইলে এ-সব ভালো করিয়া দেখা যায় না। আর জাহাজের হাসফাসানি, আগুনের তাপ, খালাসিদের গোলমাল, মায়াবদ্ধ দানবের মতে দীপ্তনেত্র এঞ্জিনের গে-ভরে সনিশ্বাস খাটুনি, দুই পাশে অবিশ্রাম আবর্তিত দুই সহস্ৰবাহু চাকার সরোষ ফেন-উদগার— এ-সকল, গঙ্গার প্রতি । অত্যন্ত অত্যাচার বলিয়া বোধ হয়। তাহা ছাড়া গঙ্গার সৌন্দর্য উপেক্ষা করিয়া ছুটিয়া চলা কার্যতংপর অতিসভ্য উনবিংশ শতাব্দীকেই শোভা পায়, কিন্তু রসঙ্গের ইহা সহ হয় না। এ যেন আপিসে যাইবার সময় নাকে মুখে ভাত গোজা। জয়ের অপমান। যেন গঙ্গাযাত্রার একটা সংক্ষিপ্ত সংস্করণ গড়িয়া তোলা । এ যেন মহাভারতের সূচীপত্র গলাধঃকরণ করা ।