পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫৫৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Teev- রবীন্দ্র-রচনাবলী পরিদর্শন করিতে করিতে, ভারতবর্ব সাতটি প্রকাও কাও এবং আঠারোটি বিপুলায়তন পর্ব অকাতরচিত্তে যুদ্ধমন্দগতিতে পরিভ্রমণ করিতে কিছুমাত্র ক্লাস্তি বোধ করে না। আবার, গল্প শুনিবার আগ্রহ অনুসারে গল্পের প্রকৃতিও ভিন্নরূপ হইয়া থাকে। ছয়টি কাণ্ডে যে গল্পটি বেদন ও আনন্দে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিয়াছে, একটিমাত্র উত্তরকাণ্ডে তাহাকে অসংকোচে চূর্ণ করিয়া ফেলা কি সহজ ব্যাপার ? আমরা লঙ্কাকাও পর্যন্ত এই দেখিয়া আসিলাম যে, অধৰ্মচারী নিষ্ঠুর রাক্ষস রাবণই সীতার পরম শত্রু ; অসাধারণ শৌর্যে ও বিপুল আয়োজনে সেই ভয়ংকর রাবণের হাত হইতে সীতা যখন পরিত্রাণ পাইলেন তখন আমাদের সমস্ত চিন্তা দূর হইল, আমরা আনন্দের জন্য প্রস্তুত হইলাম, এমন সময় মুহূর্তের মধ্যে কবি দেখাইয়া দিলেন– সীতার চরম শত্রু অধাৰ্মিক রাবণ নহে, সে শক্র ধর্মনিষ্ঠ রাম ; নির্বাসনে তাহার তেমন সংকট ঘটে নাই, যেমন তাহার রাজাধিরাজ স্বামীর গৃহে। ষে সোনার তরণী দীর্ঘকাল যুঝিয়া ঝড়ের হাত হইতে উদ্ধার পাইল, ঘাটের পাষাণে ঠেকিবামাত্র এক মুহূর্তে তাহা দুইখানা হইয়া গেল । গল্পের উপর যাহার কিছুমাত্র মমতা আছে সে কি এমন আকস্মিক উপদ্রব সহ করিতে পারে? যে বৈরাগ্যপ্রভাবে আমরা গল্পের নানাবিধ প্রাসঙ্গিক ও অপ্রাসঙ্গিক বাধা সন্থ করিয়াছি সেই বৈরাগ্যই গল্পটির অকস্মাং অপঘাতমৃত্যুতে আমাদের ধৈর্ধ রক্ষা করিয়া থাকে । মহাভারতেও তাই। এক স্বর্গারোহণপর্বেই কুরুক্ষেত্র-যুদ্ধটার স্বৰ্গপ্রাপ্তি হইল। গল্পপ্রিয় ব্যক্তির কাছে গল্পের অবসান যেখানে মহাভারত সেখানে থামিলেন না— অতবড়ো গল্পটাকে বালুনির্মিত খেলাঘরের মতো এক মুহূর্তে ভাঙিয়া দিয়া চলিয়া গেলেন ; সংসারের প্রতি এবং গল্পের প্রতি যাহাদের বৈরাগ্য তাহার। ইহার মধ্য হইতে সত্য লাভ করিল এবং ক্ষুব্ধ হইল না । মহাভারতকে যে লোক গল্পের মতো করিয়া পড়িতে চেষ্টা করে লে মনে করে অর্জুনের শৌর্য অমোঘ, সে মনে করে শ্লোকের উপর শ্লোক গাথিয়া মহাভারতকার অর্জনের জয়স্তম্ভ অভ্রভেদী করিয়া তুলিতেছেন— কিন্তু সমস্ত কুরুক্ষেত্র-যুদ্ধের পর হঠাৎ একদিন এক স্থানে অতি জয় কথার মধ্যে দেখা গেল, এক দল সামান্ত দহা কৃষ্ণের রমণীদিগকে অর্জনের হাত হইতে কাড়িয়া লইয়া গেল, নারীগণ কৃষ্ণসখা পার্থকে জাহান করিয়া জার্তম্বরে বিলাপ করিতে লাগিলেন, অর্জুন গাওঁীব তুলিতে পারিলেন না। অর্জনের এমন অতাবনীয় অবমাননা ৰে মহাভারতকারের কল্পনায় স্থান পাইতে পারে তাহ পূর্ববর্তী অতওল পর্বের মধ্যে কেহ সন্দেহ করিতে পারে নাই। কিন্তু কাহারও উপর কবির মমতা নাই। যেখানে শ্রোতা বৈরাগী, লৌকিক শৌর্ষীর্ষমন্তত্বের অবগুণ্ডাৰী পরিণাম স্বরণ করিয়া