পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৪৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যোগাযোগ OSRA অপমান । কিছু করবার নেই, কপালে করাঘাত ছাড়া। উপায় করবার পথ বিধাতা মেয়েদের দিলেন না, দিলেন কেবল ব্যথা পাবার শক্তি । অসম্ভব একটা-কিছু ঘটে না কি ? কোনো দেবতার বর, কোনো যক্ষের ধন, পূর্বজন্মের কোনো-একটা বাকিপড়া পাওনার এক মুহুর্তে পরিশোধ ? এক-একদিন রাতে বিছানা থেকে উঠে বাগানের মর্মরিত ঝাউগাছগুলোর মাথার উপরে চেয়ে থাকে, মনে মনে বলে, “কোথায় আমার রাজপুত্র, কোথায় তোমার সাতরাজার-ধন মানিক, বাঁচাও আমার ভাইদের, আমি চিরদিন তোমার দাসী হয়ে থাকব ।” বংশের দুৰ্গতির জন্য নিজেকে যতই অপরাধী করে, ততই হৃদয়ের সুধাপাত্র উপুড় করে ভাইদের ওর ভালোবাসা দেয়- কঠিন দুঃখে নেংড়ানো ওর ভালোবাসা । কুমুর পরে তাদের কর্তব্য করতে পারছে না বলে ওর ভাইরাও বড়ো ব্যথার সঙ্গে কুমুকে তাদের স্নেহ দিয়ে ঘিরে রেখেছে। এই পিতৃমাতৃহীনাকে উপরওয়ালা যে স্নেহের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করেছেন, ভাইরা তা ভরিয়ে দেবার জন্যে সর্বদা উৎসুক । ও যে চাঁদের আলোর টুকরো, দৈন্যের অন্ধকারকে একা মধুর করে রেখেছে। যখন মাঝে মাঝে দুর্ভাগ্যের বাহন বলে নিজেকে সে ধিক্কার দেয়, দাদা বিপ্রদাস হেসে বলে, “কুমু, তুই নিজেই তো আমাদের সৌভাগ্য- তোকে না পেলে বাড়িতে শ্ৰী থাকত কোথায় ?” কুমুদিনী ঘরে পড়াশুনো করেছে। বাইরের পরিচয় নেই বললেই হয় । পুরোনো নতুন দুই কালের আলো-আঁধারে তার বাস। তার জগৎটা আবছায়া- সেখানে রাজত্ব করে সিদ্ধেশ্বরী, গন্ধেশ্বরী, ঘেটু, ষষ্ঠী ; সেখানে বিশেষ দিনে চন্দ্ৰ দেখতে নেই ; শাখ বাজিয়ে গ্রহণের কুদৃষ্টিকে তাড়াতে হয়, অম্বুবাচীতে সেখানে দুধ খেলে সাপের ভয় ঘোচে ; মন্ত্র পড়ে, পাঠা মানত করে, সুপুরি আলো-চাল ও পাচ পয়সার সিন্নি মেনে, তাগাতাবিজ পারে, সে-জগতের শুভ-অশুভের সঙ্গে কারবার ; স্বস্ত্যয়নের জোরে ভাগ্য-সংশোধনের আশা- সে আশা হাজারবার ব্যর্থ হয় । প্ৰত্যক্ষ দেখা যায়, অনেক সময়েই শুভলগ্নের শাখায় শুভফল ফলে না, তবু বাস্তবের শক্তি নেই প্রমাণের দ্বারা স্বপ্নের মোহ কাটাতে পারে। স্বপ্নের জগতে বিচার চলে না, একমাত্র চলে মেনে-চলা। এ জগতে দৈবের ক্ষেত্রে যুক্তির সুসংগতি, বুদ্ধির কর্তৃত্ব ভালো-মন্দর নিত্যতত্ত্ব নেই বলেই কুমুদিনীর মুখে এমন একটা করুণা। ও জানে, বিনা অপরাধেই ও লাঞ্ছিত । আট বছর হল সেই লাঞ্ছনাকে একান্ত সে নিজের বলেই গ্ৰহণ করেছিল— সে তার পিতার মৃত্যু নিয়ে । 8 পুরোনো ধনী-ঘরে পুরাতন কাল যে দুর্গে বাস করে তার পাকা গাথুনি। অনেক দেউড়ি পার হয়ে তবে নতুন কালকে সেখানে ঢুকতে হয়। সেখানে যারা থাকে নতুন যুগে এসে পৌছোতে তাদের বিস্তর লেট হয়ে যায়। বিপ্রদাসের বাপ মুকুন্দলালও ধাবমান নতুন যুগকে ধরতে পারেন নি । দীর্ঘ র্তার গীেরবর্ণ দেহ, বাবরি-কাটা চুল, বড়ো বড়ো টানা চোখে অপ্রতিহত প্ৰভুত্বের দৃষ্টি । ভারী গলায় যখন হাক পাড়েন, অনুচর-পরিচরদের বুক থর থর করে কেঁপে ওঠে। যদিও পালোয়ান রেখে নিয়মিত কুস্তি করা তার অভ্যাস, গায়ে শক্তিও কম নয়। তবু সুকুমার শরীরে শ্রমের চিহ্ন নেই। পরনে চুনট-করা ফুরফুরে মসলিনের জামা, ফরাসডাঙা বা ঢাকাই ধুতির বহু যত্নবিন্যস্ত কেঁচা ভুলুষ্ঠিত, কর্তার আসন্ন আগমনের বাতাস ইস্তাম্বুল-আতারের সুগন্ধবার্তা বহন করে। পানের সোনার বাটা হাতে খানসামা পশ্চাদবতী, দ্বারের কাছে সর্বদা হাজির তকমা-পরা আরদালি। সদর-দরজায় বৃদ্ধ চন্দ্ৰভান জমাদার তামাক মাখা ও সিদ্ধি কোটার অবকাশে বেঞ্চে বসে লম্বা দাড়ি দুই ভাগ করে বার বার আঁচড়িয়ে দুই কানের উপর বঁাধে, নিম্নতন দারোয়ানরা তলোয়ার হাতে পাহারা দেয়। দেউড়ির দেওয়ালে ঝোলে নানা রকমের ঢাল, বঁাকা তলোয়ার, বহুকালের পুরানো বন্দুক বল্লম বর্শা । বৈঠকখানায় মুকুন্দলাল বসেন গদির উপর, পিঠের কাছে তাকিয়া। পরিষদেরা বসে নীচে, সামনে বায়ে দুই ভাগে । হকাবরাদারের জানা আছে, এদের কার সম্মান কোন রকম ইকোয় রক্ষা হয়