পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৫৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

అes রবীন্দ্র-রচনাবলী সুবোধ প্রথম-প্রথম হিসেব করেই খরচ চালাত । বাড়ির দুঃখের কথা তখনো মনে তাজা ছিল। এখন সেটা যতই ছায়ার মতো হয়ে এসেছে, খরচও ততই চলেছে বেড়ে । বলছে, বড়োরকম চালে চলতে না পারলে এখানকার সামাজিক উচ্চশিখরের আবহাওয়ায় পৌছনো যায় না । আর তা না গেলে বিলোতে আসাই ব্যর্থ হয় । h দায়ে পড়ে দুই-একবার বিপ্রদাসকে তার-যোগে অতিরিক্ত টাকা পাঠাতে হয়েছে। এবার দাবি এসেছে হাজার পাউণ্ডের- জরুরি দরকার । ل বিপ্ৰদাস মাথায় হাত দিয়ে বললে, পাব কোথায় ? গায়ের রক্ত জল করে কুমুর বিবাহের জন্য টাকা জমাচ্ছি। শেষে কি সেই টাকায় টান পড়বে ? কী হবে সুবোধের ব্যারিস্টার হয়ে, কুমুর ভবিষ্যৎ ফতুর করে যদি তার দাম দিতে হয় ? সে রাত্রে বিপ্রদাস বারান্দায় পায়চারি করে বেড়াচ্ছে। জানে না, কুমুদিনীর চােখেও ঘুম নেই। এক সময়ে যখন বড়ো অসহ্য হল কুমু ছুটে এসে বিপ্রদাসের হাত ধরে বললে, “সত্যি করে বলে দাদা, ছোড়দাদার কী হয়েছে ? পায়ে পড়ি, আমার কাছে লুকিয়ে না।” বিপ্রদাস বুঝলে গোপন করতে গেলে কুমুদিনীর আশঙ্কা আরো বেড়ে উঠবে। একটু চুপ করে থেকে বললে, “সুবোধ টাকা চেয়ে পাঠিয়েছে, অত টাকা দেবার শক্তি আমার নেই।” কুমু বিপ্ৰদাসের হাত ধরে বললে, “দাদা, একটা কথা বলি, রাগ করবে না বলে ।” “রাগ করবার মতো কথা হলে রাগ না করে বাচিব কী করে ?” “না দাদা, ঠাট্ট নয়, শোনো আমার কথা- মায়ের গয়না তো আমার জন্যে আছে, তাই নিয়ে—” “চুপ, চুপ, তোর গয়নায় কি আমরা হাত দিতে পারি।” “আমি তো পারি।” “না, তুইও পারিস নে। থাক সে-সব কথা, এখন ঘুমোতে যা ।” কলকাতা শহরের সকাল, কাকের ডাক ও স্ক্যাভেঞ্জারের গাড়ির খড়খাড়ানিতে রাত পোয়ালো । দূরে কখনাে স্টীমারের, কখনাে তেলের কলের বাঁশি বাজে। বাসার সামনের রাস্তা দিয়ে একজন লোক মই কাধে জ্বরারি-বটিকার বিজ্ঞাপন খাটিয়ে চলেছে ; খালি-গাড়ির দুটাে গোরু গাড়োয়ানের দুই হাতের প্রবল তাড়ার উত্তেজনায় গাড়ি নিয়ে দ্রুতবেগে ধাবমান ; কল থেকে জল নেবার প্রতিযোগিতায় এক হিন্দুস্থানি মেয়ের সঙ্গে উড়িয়া ব্ৰাহ্মণের ঠেলাঠেলি বাকবাকি জমেছে। বিপ্রদাস বারান্দায় বসে ; গুড়গুড়ির নলটা হাতে ; মেজেতে পড়ে আছে না-পড়া খবরের কাগজ । . কুমু এসে বললে, “দাদা, না” বোলো না ।” “আমার মতের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করবি তুই ? তাের শাসনে রাতকে দিন, 'না'-কে হী করতে হবে ।” “না, শোনো বলি- আমার গয়না নিয়ে তোমার ভাবনা ঘুচুক ।” তােক বলছি। তার গল্প নেিয় আমার ভাল ফুৰে এক কথা ভারতে পারলি কােন “সে জানি নে, কিন্তু তোমার এই ভাবনা আমার সয় না।” । “ভেবেই ভাবনা শেষ করতে হয় রে, তাকে ফাকি দিয়ে থামাতে গেলে বিপরীত ঘটে । একটু ধৈর্য ধর, একটা ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।” । - বিপ্রদাস সে মেলে চিঠিতে লিখলে, টাকা পাঠাতে হলে কুমুর পণের সম্বলে হাত দিতে হয় ; সে অসম্ভব । যথাসময়ে উত্তর এল । সুবোধ লিখেছে কুমুর পণের টাকা সে চায় না । সম্পত্তিতে তার নিজের অর্ধ অংশ বিক্রি করে যেন টাকা পাঠানো হয় । সঙ্গে সঙ্গেই পাওয়ার অফ অ্যাটনি পাঠিয়েছে। এ চিঠি বিপ্রদাসের বুকে বাণের মতো বিধলা। এতবড়ো নিষ্ঠুর চিঠি সুবোধ লিখল কী করে !