পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৭৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

V)08 রবীন্দ্র-রচনাবলী বউয়ের মুখে একটু মধু দিয়ে বললেন, “আহা, এতদিন পরে আমাদের নীল গগনে উঠল পূর্ণচাঁদ, নীল সরোবরে ফুটল সোনার পদ্ম।” বরকনে গাড়ি থেকে নামল। যুবক-অভ্যাগতদের দৃষ্টি ঈর্ষান্বিত । একজন বললে, “দৈত্য স্বৰ্গ লুট করে এনেছে রে, অন্সরী সোনার শিকলে বাধা ।” আর-একজন বললে, “সাবেক কালে এমন মেয়ের জন্যে রাজায় রাজায় লড়াই বেধে যেত, আজ তিসি-চালানির টাকাতেই কাজ সিদ্ধি । কলিযুগে দেবতাগুলো বেরসিক । ভাগ্যচক্রের সব গ্রহনক্ষত্রই বৈশ্যবর্ণ।” তার পরে বরণ, স্ত্রী-আচার প্রভৃতির পালা শেষ হতে হতে যখন সন্ধ্যা হয়ে আসে তখন কালরাত্রির মুখে ক্রিয়াকর্ম সাঙ্গ হল । একটিমাত্র বড়ো বোনের বিবাহ কুমুর স্পষ্ট মনে আছে। কিন্তু তাদের নিজেদের বাড়িতে কোনো নতুন বউ আসতে সে দেখে নি। যৌবনারম্ভের পূর্বে থেকেই সে আছে কলকাতায়, দাদার নির্মল মেহের আবেষ্টনে । বালিকার মনের কল্পজগৎ সাধারণ সংসারের মোটা ছাচে গড়া হতে পায় নি । বাল্যকালে পতিকামনায় যখন সে শিবের পূজা করেছে তখন পতির ধ্যানের মধ্যে সেই মহাতপস্বী রাজত-গিরিনিভ শিবকেই দেখেছে। সাধবী নারীর আদর্শরূপে সে আপন মাকেই জানত | কী স্নিগ্ধ শান্ত কমনীয়তা, কত ধৈৰ্য, কত দুঃখ, কত দেবপূজা, মঙ্গলাচরণ, অক্লান্ত সেবা । অপর পক্ষে তার স্বামীর দিকে ব্যবহারের ত্রুটি চরিত্রের স্থলন ছিল ; তৎসত্ত্বেও সে চরিত্র ঔদার্যে বৃহৎ, পৌরুষে দৃঢ়, তার মধ্যে হীনতা কপটতা লেশমাত্র ছিল না, যে একটা মৰ্যাদাবােধ ছিল সে যেন দূরকালের পৌরাণিক আদর্শের । তার জীবনের মধ্যে প্রতিদিন এইটেই প্ৰমাণ হয়েছে যে, প্ৰাণের চেয়ে মান বড়ো, অর্থের চেয়ে ঐশ্বর্য। তিনি ও তীর সমপর্যায়ের লোকেরা বড়ো বহরের মানুষ। তাদের ছিল নিজেদের ক্ষতি করেও অক্ষত সম্মানের গৌরব রক্ষা, অক্ষত সঞ্চায়ের অহংকার প্রচার নয় । কুমুর ষেদিন বা চোখ নাচল সেদিন সে তার সব ভক্তি নিয়ে, আত্মোৎসর্গের পূর্ণ সংকল্প নিয়ে প্ৰস্তুত হয়ে দাড়িয়েছিল । কোথাও কোনো বাধা বা খর্বতা ঘটতে পারে এ কথা তার কল্পনাতেই আসে নি । দময়ন্তী কী করে আগে থাকতে জেনেছিলেন যে, বিদৰ্ভরাজ নলকেই বরণ করে নিতে হবে । তার মনের ভিতরে নিশ্চিত বার্তা এসে পৌঁচেছিল— তেমনি নিশ্চিত বার্তা কি কুমু পায় নি ? বরণের আয়োজন। সবই প্ৰস্তুত ছিল, রাজাও এলেন, কিন্তু মনে যাকে স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিল, বাইরে তাকে দেখলে কই ? রূপেতেও বাধত না, বয়সেও বাধত না । কিন্তু রাজা ? সেই সত্যকার রাজা কোথায় ? তার পরে আজ, যে অনুষ্ঠানের দ্বার দিয়ে কুমুকে তার নতুন সংসারে আহবান করলে তাতে এমন কোনো বজগভীর মঙ্গলধ্বনি বাজল না কেন যার ভিতর দিয়ে এই নববধূ আকাশের সপ্তর্ষিদের শুনতে পেত ! সমস্ত অনুষ্ঠানকে পরিপূর্ণ করে এমন বন্দনাগান উদাত্ত স্বরে কেন জাগল ୩ জগতঃ পিতরেী বন্দে পার্বতীপরমেশ্বরেী সেই “জগতঃ পিতরেী" র্যার মধ্যে চিরপুরুষ ও চিরনারী বাক্য ও অর্থের মতো একত্র মিলিত হয়ে আছে ? RNR মধুসূদন যখন কলকাতায় বাস করতে এল, তখন প্রথমে সে একটি পুরোনো বাড়ি কিনেছিল, সেই চকমেলানো বাড়িটাই আজ তার অন্তঃপুর-মহল । তার পরে তারই সামনে এখনকার ফ্যাশানে একটা মস্ত নতুন মহল এরই সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে, সেইটো ওর বৈঠকখানা-বাড়ি। এই দুই মহল যদিও সংলগ্ন তবুও এরা সম্পূর্ণ আলাদা দুই জাত । বাইরের মহলে সর্বত্রই মার্বলের মেজে, তার উপরে বিলিতি কাপেট, দেয়ালে চিত্রিত কাগজ মারা এবং তাতে ঝুলছে নানারকমের ছবি- কোনোটা এনগ্ৰেভিং, কোনোটা ওলিয়োগ্রাফ, কোনোটা অয়েলপেন্টিং- তার বিষয় হচ্ছে, হরিণকে তাড়া করেছে শিকারী কুকুর, কিংবা ডাবির ঘোড়দৌড় জিতেছে এমন-সব বিখ্যাত ঘোড়া, বিদেশী ল্যান্ডস্কেপ, কিংবা স্নানরত