পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৭৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

GRG's w©¢ዓ করছিল- এই ছেলেকে বুকে চেপে ধরে যেন বঁাচল । হঠাৎ কেমন মনে হল কতদিন ঠাকুরঘরে যে গোপালকে ফুল দিয়ে এসেছে, এই ছেলেটির মধ্যে সে-ই ওর কোলে এসে বসল। ঠিক যে-সময়ে ডাকছিল সেই দুঃখের সময়েই এসে ওকে বললে, “এই যে আমি আছি তোমার সান্তুনা ।” মোতির গোল গোল গাল টিপে ধরে কুমু বললে, “গোপাল, ফুল নেবে ?” কুমুর মুখ দিয়ে গোপাল ছাড়া আর কোনো নাম বেরোল না। হঠাৎ নিজের নামান্তরে হাবলুর কিছু বিস্ময় বোধ হল- কিন্তু এমন সুর ওর কানে পীেচেছে যে, কিছু আপত্তি ওর মনে আসতে পারে না । এমন সময়ে পাশের ঘর থেকে মোতির মা ছেলের গলা শুনতে পেয়ে ছুটে এসে বললে, “ঐ রে, বঁদর-ছেলেটা এসেছে বুঝি।” শ্ৰীমোতিলাল ঘোষাল -এর সম্মান আর থাকে না , নালিশে-ভরা চোখ তুলে নিঃশব্দে মায়ের মুখের দিকে সে চেয়ে রইল, ডান হাতে জ্যাঠাইমার আঁচল চেপে । কুমুহাবলুকে তার বা হাত দিয়ে বেড়ে নিয়ে বললে, “আহা, থাক-না।” “না ভাই, অনেক রাত হয়ে গেছে। এখন শুতে যাক- এ বাড়িতে ওকে খুব সহজেই মিলবে, ওর মতো সস্তা ছেলে আর কেউ নেই।” বলে মোতির মা অনিচ্ছুক ছেলেকে শোয়াবার জন্যে নিয়ে গেল । এই এতটুকুতেই কুমুর মনের ভার গেল হালকা হয়ে । ওর মনে হল প্রার্থনার জবাব পেলুম, জীবনের সমস্যা সহজ হয়ে দেখা দেবে এই ছোটো ছেলেটির মতোই । SO অনেক রাত্তিরে মোতির মা এক সময়ে জেগে উঠে দেখলে কুমু বিছানায় উঠে বসে আছে, তার কোলের উপর দুই হাত জোড়া, ধ্যানাবিষ্ট চােখ দুটি যেন সামনে কাকে দেখতে পাচ্ছে। মধুসূদনকে । যতই সে হৃদয়ের মধ্যে গ্ৰহণ করতে বাধা পায়, ততই তার দেবতাকে দিয়ে সে তার স্বামীকে আবৃত করতে চায়। স্বামীকে উপলক্ষ করে আপনাকে সে দান করছে তার দেবতাকে । দেবতা তীর পূজাকে বড়ো কঠিন করেছেন, এ প্রতিমা স্বচ্ছ নয়, কিন্তু এই তো ভক্তির পরীক্ষা। শালগ্রামশিলা তো কিছুই দেখায় না, ভক্তি সেই রূপহীনতার মধ্যে বৈকুণ্ঠনাথের রূপকে প্রকাশ করে কেবল আপনি জোরে । যেখানে দেখা যাচ্ছে না। সেইখানেই দেখব। এই হােক আমার সাধনা, যেখানে ঠাকুর লুকিয়ে থাকেন সেইখানে গিয়েই তার চরণে আপনাকে দান করব, তিনি আমাকে এড়াতে পারবেন না। “মেরে গিরিধির গোপাল, ঔর নাহি কোহি- দাদার কাছে শেখা মীরাবাই-এর এই গানটা বার বার মনে মনে আওড়াতে লাগিল । মধুসূদনের অত্যন্ত রূঢ় যে পরিচয় সে পেয়েছে তাকে কিছুই নয় বলে জলের উপরকার বুদবুদ বলে উড়িয়ে দিতে চায়- চিরকালের যিনি সত্য, সমস্ত আবৃত করে তিনিই আছেন, “ঔর নাহি কোহি, ঔর নাহি কেহি ।” এ ছাড়া আর-একটা পীড়ন আছে তাকেও মায়া বলতে চায়- সে হচ্ছে জীবনের শূন্যতা । আজ পর্যন্ত যাদের নিয়ে ওর সমস্ত কিছু গড়ে উঠেছে, যাদের বাদ দিতে গেলে জীবনের অর্থ থাকে না, তাদের সঙ্গে বিচ্ছেদ- সে নিজেকে বলছে এই শূন্যও পূর্ণA. ‘বাপে ছাড়ে, মায়ে ছাড়ে, ছাড়ে সগা সহী, মীরা প্ৰভু লগন লগী যো ন হােয়ে হােয়ী ।” ছেড়েছেন তো বাপ, ছেড়েছেন, তো মা, কিন্তু তাদের ভিতরেই যিনি চিরকালকার তিনি তো ছাড়েন নি। ঠাকুর আরো যা-কিছু ছাড়ােন-না কেন, শূন্য ভরবেন বুলেই ছাড়িয়েছেন। আমি লেগে রইলুম, যা হয় তা হােক । মনের গান কখন তার গলায় ফুটে উঠল তা টেরই পেলে না- দুই চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগিল । মোতির মা কথাটি বললে না, চুপ করে দেখলে, আর শুনলে। তার পরে কুমু যখন অনেকক্ষণ ধরে প্ৰণাম করে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে শুয়ে পড়ল তখন মেতির মা'র মনে একটা চিন্তা দেখা দিল যা পূর্বে আর কখনো ভাবে নি । ও ভাবতে লাগল, আমাদের যখন বিয়ে হয়েছিল তখন আমরা তো কচি খুঁকি ছিলুম, মন বলে