পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪২২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যোগাযোগ 8 ΟνΌ এমন সময়ে শোবার ঘরে এল মুরলী বেহারা বিছানা করতে । শীতে কঁাপিছে তার হাত । গায়ে একখানা জীৰ্ণ ময়লা র্যাপার। মাথায় টাক, রাগ টেপা, গাল বসা, কিছুকালের না-কামানো কঁচাপাকা দাড়ি খোচা খোচা হয়ে উঠেছে। অনতিকাল পূর্বেই সে ম্যালেরিয়ায় ভুগেছিল, শরীরে রক্ত নেই বললেই হয়, ডাক্তার বলেছিল কাজ ছেড়ে দিয়ে দেশে যেতে, কিন্তু নিষ্ঠুর নিয়তি । কুমু বললে, “শীত করছে। মুরলী ?” “হা মা, বাদল করে ঠাণ্ডা পড়েছে।” “গরম কাপড় নেই তোমার ?” স্বার দিনে মহারাজা দিয়েছিলেন নাতির ধােসর বেমারি হতেই ডাকারের কথায় তাকে छेि ! ॥' কুমু একটি পুরোনাে ছাই রঙের আলোয়ান পাশের ঘরের আলমারি থেকে বের করে এনে বললে, “আমার এই কাপড়টি তোমাকে দিলুম।” মুরলী গড় হয়ে বললে, “মাপ করো মা, মহারাজা রাগ করবেন।” কুমুর মনে পড়ে গেল, এ বাড়িতে দয়া করবার পথ সংকীর্ণ। কিন্তু ঠাকুরের কাছ থেকে নিজের ফুলেঃ যে গুর দয়া চাই, পুণ্যকর্ম তারই পথ। কুন্তু ক্ষোভের সঙ্গে আলােয়ানটা মাটিতে ফেলে মুরলী হাত জোড় করে বললে, “রানীমা, তুমি মা লক্ষ্মী, রাগ কোরো না । গরম কাপড়ে আমার শুরু হয় না। আমি থাকি হকাকারের ঘরে, সেখানে গামলায় গুলের আগুন আমি বেশ গরম =ت* কুমু বললে, “মুরলী, নবীন ঠাকুরপো যদি বাড়ি এসে থাকেন তাকে ডেকে দাও।” নবীন ঘরে ঢুকতেই কুমু বললে, “ঠাকুরপো, তোমাকে একটি কাজ করতেই হবে । বলো, করবে ?” “নিজের অনিষ্ট যদি হয় এখনই করব, কিন্তু তোমার অনিষ্ট হলে কিছুতেই করব না।” “আমার আর কত অনিষ্ট হবে ? আমি ভয় করি নে।” বলে নিজের হাত থেকে মোটা সোনার বালাজোড়া খুলে বললে, “আমায় এই বালা বেচে দাদার জন্যে স্বস্ত্যয়ন করাতে হবে।” “কিছু দরকার হবে না, বউরানী, তুমি তাকে যে ভক্তি করো তারই পুণ্যে প্রতিমুহূর্তে তার জন্যে স্বস্ত্যয়ন হচ্ছে ।” “ঠাকুরপো, দাদার জন্যে আর কিছুই করতে পারব না। কেবল যদি পারি দেবতার দ্বারে তার জন্যে সেবা পৌছিয়ে দেব ।” “তোমাকে কিছু করতে হবে না, বউরানী। আমরা সেবক আছি কী করতে ?” “তোমরা কী করতে পার বলো ?” “আমরা পাপিষ্ঠ, পাপ করতে পারি। তাই করেও যদি তােমার কোনাে কাজে লাগি তা হলে ধন্য হব ।” “ঠাকুরপো, এ কথা নিয়ে ঠাট্টা কোরো না।” “একটুও ঠাট্টা নয়। পুণ্য করার চেয়ে পাপ করা অনেক শক্ত কাজ, দেবতা যদি তা বুঝতে পারেন তা হলে পুরস্কার দেবেন।” । 卓 নবীনের কথার ভাবে দেবতার প্রতি উপেক্ষা কল্পনা করে কুমুর মনে স্বভাবত আঘাত লাগতে পারত, কিন্তু তার দাদাও যে মনে মনে দেবতাকে শ্রদ্ধা করে না, এই অভক্তির পরে সে রাগ করতে পারে না যে। ছোটাে ছেলের দুষ্টুমির পরেও মায়ের যেমন সকৌতুক স্নেহ, এইরকম অপরাধের পরে ওরাও সেই ভাব । কুমু একটু স্নান হাসি হেসে বললে, “ঠাকুরপো, সংসারে তোমরা নিজের জোরে কাজ করতে পার ; আমাদের যে সেই নিজের জোর খাটাবার জো নেই। যাদের ভালোবাসি। অথচ নাগাল মেলে না, তাদের কাজ করব কী করে ? দিন যে কাটে না, কোথাও যে রাস্তা খুঁজে পাই নে। আমাদের কী দয়া ।