পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪২৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 So রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী 88 বাইরে অন্ধকারে দরজার আড়ালে একটি মানুষ এতক্ষণ দাড়িয়ে ছিল-- হাবলু। কম সাহস না। ’ মধুসূদনকে যমের মতো ভয় করে, তবু ছিল কাঠের পুতুলের মতো স্তব্ধ হয়ে । সেদিন মধুসূদনের কাছে তাড়া খাওয়ার পর থেকে জ্যাঠাইমার কাছে আসবার সুবিধে হয় নি, মনের ভিতর ছটফট করেছে। আজ এই সন্ধ্যাবেলায় আসা নিরাপদ ছিল না । কিন্তু ওকে বিছানায় শুইয়ে রেখে মা যখন ঘরকন্নার কাজে চলে গেছে এমন সময় কানে এল এসরাজের সুর। কী বাজছে জানত না, কে বাজাচ্ছে বুঝতে পারে নি, জ্যাঠাইমার ঘর থেকে আসছে এটা নিশ্চিত ; জ্যাঠামশায় সেখানে নেই এই তার বিশ্বাস, কেননা তার সামনে কেউ বাজনা বাজাতে সাহস করবে। এ কথা সে মনেই করতে পারে না । উপরের তলায় দরজার কাছে এসে জ্যাঠামশায়ের জুতোজোড়া দেখেই পালাবার উপক্রম করলে । কিন্তু যখন বাইরে থেকে চোখে পড়ল ওর জ্যাঠাইমা নিজে বাজাচ্ছেন, তখন কিছুতেই পালাতে পা সরল না। দরজার আড়ালে লুকিয়ে শুনতে লেগেছে। প্রথম থেকেই জ্যাঠাইমাকে ও জানে আশ্চর্য আজ বিস্ময়ের অন্ত নেই। মধুসূদন চলে যেতেই মনের উচ্ছাস আর ধরে রাখতে পারলে না- ঘরে ঢুকেই কুমুর কোলে গিয়ে বসে গলা জড়িয়ে ধরে কানের কাছে বললে, “জ্যাঠাইমা ।” কুমু তাকে বুকে চেপে ধরে বললে, “এ কী, তোমার হাত যে ঠাণ্ডা ! বাদলার হাওয়া লাগিয়েছ। বুঝি ?” হাবলু কোনাে উত্তর করলে না, ভয় পেয়ে গেল। ভাবলে জ্যাঠাইমা এখনই বুঝি বিছানায় শুতে পাঠিয়ে দেবে। কুমু তাকে শালের মধ্যে ঢেকে নিয়ে নিজের দেহের তাপে গরম করে বললে, “এখনো শুতে যাও নি গোপাল ?” “তোমার বাজনা শুনতে এসেছিলুম। কেমন করে বাজাতে পারলে জ্যাঠাইমা ?” “তুমি যখন শিখবে তুমিও পারবে ।” “আমাকে শিখিয়ে দেবে ?” এমন সময় মোতির মা ঝড়ের মতো ঘরে ঢুকেই বলে উঠল, “এই বুঝি দস্যি, এখানে লুকিয়ে বসে ! আমি ওকে সাতরাজ্যি খুঁজে বেড়াচ্ছি। এ দিকে সন্ধ্যাবেলায় ঘরের বাইরে দু’পা চলতে গা ছম ছম করে, জ্যাঠাইমার কাছে আসবার সময় ভয়ডর থাকে না। চল শুতে চল।” হাবলু কুমুকে আঁকড়ে ধরে রইল। " কুমু বললে, “আহা, থাক-না। আর-একটু।” “এমন করে সাহস বেড়ে গেলে শেষকালে বিপদে পড়বে। ওকে শুইয়ে আমি এখনই আসছি।” কুমুর বড়ো ইচ্ছে হল হাবলুকে কিছু দেয়, খাবার কিংবা খেলার জিনিস। কিন্তু দেবার মতো কিছু নেই, তাই ওকে চুমো খেয়ে বললে, “আজ শুতে যাও, লক্ষ্মী ছেলে, কাল দুপুরবেলা তোমাকে বাজনা শোনাব ।” হাবলু করুণ মুখে উঠে মায়ের সঙ্গে চলে গেল । - কিছুক্ষণ পরেই মোতির মা ফিরে এল। নবীনের ষড়যন্ত্রের কী ফল হল তাই জািনবার জন্যে মন অস্থির হয়ে আছে। কুমুর কাছে বসেই চােখে পড়ল, তার হাতে সেই নীলার আংটি। বুঝলে যে কাজ হয়েছে। কথাটা উত্থাপন করবার উপলক্ষ স্বরূপ বললে, “দিদি, তোমার এই বাজনােটা পেলে কেমন করে ?” কুমু বললে, “দাদা পাঠিয়ে দিয়েছেন।” “বড়োঁঠাকুর তোমাকে এনে দিলেন বুঝি ?” কুমু সংক্ষেপে বললে, “ই ।” । মোতির মা কুমুর মুখের দিকে তাকিয়ে উল্লাস বা বিস্ময়ের চিহ্ন খুঁজে পেলে না। “তোমার দাদার কথা কিছু বললেন কি ?”