পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৩৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যোগাযোগ 88 ዒ কুমু হাসতে লাগল। “বউরানী, এ ঠাট্টার কথা নয়। আমাদের বাড়ির অপবাদে তোমার আগীেরব। এখন চোখে মুখে একটু জল দিয়ে এসো, খেতে যাবে। ম্যানেজার-সাহেবের ওখানে দাদার আজ নিমন্ত্রণ। আমার বিশ্বাস তিনি আজ বাড়ির ভিতরে শুতে আসবেন না, দেখলুম। বাইরের কামরায় তার বিছানা তৈরি ।” এই খবরটা পেয়ে কুমু মনে মনে আরাম পেলে, তার পরীক্ষণেই এতটা আরাম পেলে বলে লজ্জা বোধ হল । রাত্রে শোবার ঘরে মােতির মা'র সঙ্গে নবীনের ঐ কথাটা নিয়ে পরামর্শ চলল। মােতির মা বললে, “তুমি তো দিদিকে আশ্বাস দিলে। তার পরে ?” “তার পরে আবার কী ? নবীনের যেমন কথা তেমনি কাজ । বউরানীকে যেতেই হবে, তার পরে যা হয় তা হবে ।” নতুন-গড় রাজাদের পারিবারিক মর্যাদাবোধ খুবই উগ্ৰ । এরা নিশ্চয় ঠিক করে আছেন যে, বিবাহ করে নববধূ তার পূর্ব-পদবীর চেয়ে অনেক উপরে উঠেছে। অতএব বাপের বাড়ি বলে কোনো বালাই আছে। এ কথা একেবারে ভুলতে দেওয়াই সংগত । এ অবস্থায় দুই দিক রক্ষা করা যদি অসম্ভব হয় তবে একটা দিক তো রাখতেই হবে। সেই দিকটা যে কোনটা তা নবীন মনে মনে পাকা করে রাখলে । যেখানে দাদার অধিকার চরম, সেখানে ও কোনোদিন দাদার সঙ্গে লড়াই বাধাতে সাহস করতে পারবে এ কথা আর কিছুদিন আগে নবীন স্বপ্নেও ভাবতে পারত না । স্বামীস্ট্রীতে পরামর্শ করে স্থির হল যে, কাল সকালে কুমু একবার মাত্র বিপ্রদাসের সঙ্গে কিছুক্ষণের জন্যে দেখা করে আসবে, এই প্ৰস্তাব মধুসূদনের কাছে করা হবে। যদি রাজি হয় এবং কুমুকে সেখানে পাঠানো যায় তা হলে তার পরে সেখান থেকে দু-চার দিনের মধ্যে তাকে না ফেরাবার সংগত কারণ বানানো শক্ত হবে না | r মধুসূদন বাড়ি ফিরল। অনেক রাত্রে, সঙ্গে একরাশ কাগজপত্রের বোঝা । নবীন উকি মেরে দেখলে, মধুসূদন শুতে না গিয়ে চােখে চশমা ঐটে নীল পেনসিল হাতে আপিসঘরের ডেস্কে কোনো দলিলে বা দাগ দিচ্ছে, নোটবইয়ে বা নোট নিচ্ছে। নবীন সাহস করে ঘরে ঢুকেই বললে, “দাদা, আমি কি তোমার কোনাে কাজ করে দিতে পারি ?” মধুসূদন সংক্ষেপে বললে, “না।” ব্যাবসার এই সংকটের অবস্থােটাকে মধুসূদন সম্পূর্ণ নিজে আয়ত্ত করে নিতে চায়, সবটা তার একার চােখে প্রত্যক্ষ হওয়া দরকার ; এ কাজে অন্যের দৃষ্টির সহায়তা নিতে গেলে নিজেকে দুর্বল করা হবে। নবীন কোনো কথা বলবার ছিদ্র না পেয়ে বেরিয়ে গেল। শীঘ্ৰ যে সুযোগ পাওয়া যাবে এমন তো ভাবে বোধ হল না । নবীনের পণ, কাল সকালেই বউরানীকে রওনা করে দেবে । আজ রাত্রেই সম্মতি আদায় করা চাই । খানিকক্ষণ বাদে নবীন একটা ল্যাম্প হাতে করে দাদার টেবিলের উপরে রেখে বললে, “তোমার আলো কম হচ্ছে।” মধুসূদন অনুভব করলে, এই দ্বিতীয় ল্যাম্পে তার কাজের অনেকখানি সুবিধা হল। কিন্তু এই উপলক্ষেও কোনো কথার সূচনা হতে পারল না। আবার নবীনকে বেরিয়ে আসতে হল। একটু পরেই মধুসূদনের অভ্যন্ত গুড়গুড়িতে তামাক সেজে তার চৌকির বা পাশে বসিয়ে নলটা টেবিলের উপর আস্তে আস্তে তুলে রাখলে। মধুসূদন তখনই অনুভব করলে এটারও দরকার ছিল। ক্ষণকালের জন্যে পেনসিলটা রেখে তামাক টানতে লাগিল । এই অবকাশে নবীন কথা পাড়লে, “দাদা, শুতে যাবে না ? অনেক রাত হয়েছে। বউরানী তোমার জন্যে হয়তো জেগে বসে আছেন ।” “জেগে বসে আছেন কথাটা এক মুহুর্তে মধুসূদনের মনের ভিতরে গিয়ে লাগল। ঢেউয়ের উপর দিয়ে জাহাজ যখন টলমল করতে করতে চলেছে, একটি ছোটাে ডাঙার পাখি উড়ে এসে যেন মান্তলে বসিল ; ক্ষুব্ধ সমুদ্রের ভিতরক্ষণকালের জন্যে মনে এনে দিলে শ্যামল দ্বীপের নিভৃত বনচ্ছায়ার ছবি । سمير