পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৫২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যোগাযোগ 8\OO পালিয়ে যায়। জলস্থলের নানা ইশারার মধ্যে, মন তাকেই বলে সব চেয়ে সত্য। কুমুর মন ইপিয়ে উঠে আজ পালাই-পালাই করছে সবা-কিছু থেকে, আপনার কাছ থেকে । কিন্তু এ কী বেড়া ! আজি এ বাড়িতেও মুক্তি নেই । কল্পনায় মৃত্যুকেও মধুর করে তুললে । মনে মনে বললে, কালো যমুনার পারে, সেই কালোবরণ, চলেছি তারই অভিসারে, দিনের পর দিনে— কত দীর্ঘ পথ কত দুঃখের পথ। মনে পড়ে গেল, দাদার অসুখ বেড়েছে- সেবা করতে এসে আমি অসুখ বাড়িয়েছি, এখন আমি যা করতে যাব তাতেই উলটাে হবে । দুই হাতে মুখ চেপে ধরে কুমু খুব খানিকটা কেঁদে নিলে। কান্নার বেগ থামলে স্থির করলে বাড়ি ফিরে যাবে, তা যা হয় তাই হবে- সব সহ্য করবে- শেষকালে তো আছে মুক্তি, শীতল গভীর মধুর। সেই মৃত্যুর কল্পনা মনের মধ্যে যতই স্পষ্ট করে আঁকড়ে ধরল। ততই ওর । বোধ হল জীবনের ভার একেবারে দুর্বহ হবে না, গুন গুন করে গাইতে লাগল পথপর রায়নি আঁধেরী, কুঞ্জপর দীপ উজিয়ারা । দুপুরবেলা কুমু দাদাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে চলে এসেছিল, এতক্ষণে ওষুধ আর পথ্য খাওয়াবার সময় হয়েছে। ঘরে এসে দেখলে বিপ্রদাস উঠে বসে পোর্টফোলিয়ো কোলে নিয়ে সুবোধকে ইংরেজিঃ লম্বা চিঠি লিখছে। ভংসনার সুরে কুন্তু তাকে বললে, "দাদা, আজ তুমি ভালাে করে। ঘুমোও নি।” বিপ্রদাস বললে, “তুই ঠিক করে রেখেছিস ঘুমেলেই বিশ্রাম হয় ! মন যখন চিঠি লেখার দরকার বোধ করে তখন চিঠি লিখলেই বিশ্রাম।” কুমু বুঝলে, দরকারটা ওকে নিয়েই। সমুদ্রের এপারে এক ভাইকে ব্যাকুল করেছে, সমুদ্রের ওপারে আর-এক ভাইকে ছটুফটিয়ে দেবে, কী ভাগ্য নিয়েই জন্মেছিল তাদের এই বোন ! দাদাকে চা-খাওয়ানো হলে পর আস্তে আস্তে বললে, “অনেকদিন তো হয়ে গেল, এবার বাড়ি যাওয়া ঠিক করেছি।” বিপ্রদাস কুমুর মুখের দিকে চেয়ে বোঝবার চেষ্টা করলে কথাটা কী ভাবের। এতদিন দুই ভাইবোনের মধ্যে যে স্পষ্ট বোঝাপড়া ছিল আজ আর তা নেই, এখন মনের কথার জন্যে হাতড়ে বেড়াতে হয়। বিপ্রদাস লেখা বন্ধ করলে। কুমুকে পাশে বসিয়ে কিছু না বলে তার হাতের উপর ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। কুমু তার ভাষা বুঝল। সংসারের গ্রন্থি কঠিন হয়েছে, কিন্তু ভালোবাসার একটুকুও অভাব হয় নি। চােখ দিয়ে জল পড়তে চাইল, জোর করে বন্ধ করে দিলে। কুমু মনে মনে বললে, এই ভালোবাসার উপর সে ভার চাপবে না। তাই আবার বললে, “দাদা, আমি যাওয়া ঠিক করেছি।” বিপ্রদাস কী জবাব দেবে ভেবে পেলে না, কেননা কুমুর যাওয়াটাই হয়তো ভালো, অন্তত সেটাই তো কর্তব্য । চুপ করে রইল। এমন সময় কুকুরটা ঘুম থেকে জেগে কুমুর কোলের উপর দুই পা তুলে বিপ্রদাসের প্রসাদ রুটির টুকরোর জন্যে কাকুতি জানালে । রামস্বরূপ বেহার এসে খবর দিলে মুখুজ্যোমশায় এসেছেন। কুমু উদবিগ্ন হয়ে বললে, “আজ দিনে তোমার ঘুম হয় নি, তার উপরে কালুদার সঙ্গে তর্কবিতর্ক করে ক্লান্ত হয়ে পড়বে। আমি বরঞ্চ যাই, কিছু যদি কথা থাকে শুনে নিই গে, তার পরে তোমাকে সময়মত এসে জানাব।” “ভারি ডাক্তার হয়েছিস তুই ! একজনের কথা যদি আর-একজন শুনে নেয় তাতে রোগীর মন খুব | সুস্থির হয় ভেবেছিস ?” “আচ্ছা আমি শুনব না, কিন্তু আজ থাক।” “কুমু, ইংরেজ কবি বলেছে, শ্রুত সংগীত মধুর, অশ্রুত সংগীত মধুরতর । তেমনি শ্রুত সংবাদ ক্লাস্তিকর হতে পারে, কিন্তু অশ্রুত সংবাদ আরো অনেক ক্লাস্তিকর, অতএব অবিলম্বে শুনে নেওয়াই ॐळीं ।” . “আমি কিন্তু পনেরো মিনিট পরেই আসব, আর তখনো যদি তোমাদের কথাবার্তা না থামে। তবে