পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৬৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যোগাযোগ 88 A বিপ্রদাস বললে, “বোধ করি আপিসের কাজ নিয়ে বেশি পরিশ্রম করতে হচ্ছে।” “এমনিই কী ! আপিসের কাজকর্ম। আপনিই চলে যাচ্ছে, আমাকে বড়ো কিছু দেখতে হয় না । ম্যাকনটন সাহেবের উপরেই বেশির ভাগ কাজের ভার, সার আর্থর পীবডিও আমাকে অনেকটা সাহায্য করেন ।” গুড়গুড়ি এল, পানের বাটায় পান ও মসলা নিয়ে চাকর এসে দাঁড়াল, তার থেকে একটি ছোটাে এলাচ নিয়ে মুখে পুরল, আর কিছু নিলে না । গুড়গুড়ির নল নিয়ে দুই-একবার মৃদু মৃদু টান দিলে । তার পরে গুড়গুড়ির নলটা বঁ হাতে কোলের উপরেই ধরা রইল। আর তার ব্যবহার হল না। অন্তঃপুর থেকে খবর এল জলখাবার প্রস্তুত । ব্যস্ত হয়ে বললে, “ঐটে তো পারব না। আগেই তো বলেছি, খাওয়াদাওয়া সম্বন্ধে খুব ধারকাট করেই চলতে হয় ।” বিপ্রদাস দ্বিতীয়বার অনুরোধ করলে না। চাকরকে বললে, “পিসিমাকে বলে গে, ওঁর শরীর ভালো নেই, খেতে পারবেন না ।” বিপ্রদাস চুপ করে রইল। মধুসূদন আশা করেছিল, কুমুর কথা। আপনিই উঠবে। এতদিন হয়ে গেল, এখন কুমুকে শ্বশুরবাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার প্রস্তাব বিপ্রদাস আপনিই উদবিগ্ন হয়ে করবেকিন্তু কুমুর নামও করে না যে ! ভিতরে ভিতরে একটু একটু করে রাগ জন্মাতে লাগল। ভাবলে এসে ভুল করেছি। সমস্ত নবীনের কাণ্ড । এখনই গিয়ে তাকে খুব একটা কড়া শাস্তি দেবার জন্যে মনটা ছট্‌ফটু করতে লাগল। এমন সময় সাদাসিধে সরু। কালাপেড়ে একখানি শাড়ি পরে মাথায় ঘোমটা টেনে কুমু ঘরে প্রবেশ করলে । বিপ্রদাস এটা আশা করে নি । সে আশ্চর্য হয়ে গেল । প্ৰথমে স্বামীর, পরে দাদার পায়ের ধুলো নিয়ে কুমু মধুসূদনকে বললে, “দাদার শরীর ক্লান্ত, ওঁকে বেশি কথা কওয়াতে ডাক্তারের মানা । তুমি এই পাশের ঘরে এসো।” মধুসূদনের মুখ লাল হয়ে উঠল। দ্রুত চৌকি থেকে উঠে পড়ল। কোল থেকে গুড়গুড়ির নলটা মাটিতে পড়ে গেল। বিপ্রদাসের মুখের দিকে না চেয়েই বললে, “আচ্ছা, তবে আসি ৷” প্রথম ঝোকটা হল হন হন করে গাড়িতে উঠে বাড়িতে চলে যায়। কিন্তু মন পড়েছে বাধা । অনেক দিন পরে আজ কুমুকে দেখেছে। ওকে অত্যন্ত সাদাসিধে আটপৌরে কাপড়ে এই প্রথম দেখলে । ওকে এত সুন্দর আর কখনো দেখে নি। এমন সংযত এত সহজ । মধুসূদনের বাড়িতে ও ছিল পোশাকি মেয়ে, যেন বাইরের মেয়ে, এখানে সে একেবারে ঘরের মেয়ে। আজ যেন ওকে অত্যন্ত কাছের থেকে দেখা গেল। কী স্নিগ্ধ মূর্তি ! মধুসূদনের ইচ্ছে করতে লাগল একটু দেরি না করে এখনই ওকে সঙ্গে করে নিয়ে যায় । ও আমার, ও আমারই, ও আমার ঘরের, আমার ঐশ্বর্যের আমার সমস্ত দেহমানের, এই কথাটা উলটেপালটে বলতে ইচ্ছে করে । পাশের ঘরে একটা সোফা দেখিয়ে কুমু যখন বসতে বললে, তখন ওকে বসতেই হল। নিতান্ত যদি বাইরের ঘর না হত তা হলে কুমুকে ধরে সোফায় আপনার পাশে বসােত । কুমুনা বসে একটা চৌকির পিছনে তার পিঠের উপর হাত রেখে দাঁড়াল। বললে, “আমাকে কিছু বলতে চাও ?” ঠিক এমন সুরে প্রশ্নটা মধুসূদনের ভালো লাগল না, বললে, “যাবে না বাড়িতে ?” "ਜ ? মধুসূদন চমকে উঠল— বললে, “সে কী কথা !” “আমাকে তোমার তো দরকার নেই ।” মধুসূদন বুঝলে শ্যামাসুন্দরীর খবরটা কানে এসেছে, এটা অভিমান । অভিমানটা ভালোই লাগল। বললে, “কী যে বল তার ঠিক নেই। দরকার নেই তো কী ? শূন্য ঘর কি ভালো লাগে ?” এ নিয়ে কথা-কাটাকাটি করতে কুমুর প্রবৃত্তি হল না। সংক্ষেপে আর-একবার বললে, “আমি যাব it.” “মানে কী ? বাড়ির বউ বাড়িতে যাবে না-- ?”