পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৬৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 GO রবীন্দ্র-রচনাবলী শুনতে শুনতে কুমুর মন পুলকিত হয়ে উঠল, এর চেয়ে জীবনে সুখ আর কিছু হতে পারে না । খানিক পরে বিপ্রদাস আবার বললে, “আরো-একটা কথা তোকে বলে রাখি কুমু, খুব শীঘ্রই আমাদের কাল বদল হবে, আমাদের চালও বদলাবে। আমাদের থাকতে হবে গরিবের মতো। তখন তুই থাকিবি আমাদের গরিবের ঐশ্বর্য হয়ে ।” কুমুর চােখে জল এল, বললে, “আমার এমন ভাগ্য যদি হয় তো বেঁচে যাই।” বিপ্রদাস মধুসূদনের চিঠি হাতে রাখলে, উত্তর দিলে না। ○ 。 দুদিন পরেই নবীন মোতির মা হাবলুকে নিয়ে এসে উপস্থিত । হাবলু জ্যাঠাইমার কোলে চড়ে তার বুকে মাথা রেখে কেঁদে নিলে। কান্নাটা কিসের জন্যে স্পষ্ট করে বলা শক্ত- অতীতের জন্যে অভিমান, না বর্তমানের জন্যে আবদার, না। ভবিষ্যতের জন্যে ভাবনা ? কুমু হাবলুকে জড়িয়ে ধরে বললে, “কঠিন সংসার গোপাল, কান্নার অন্ত নেই। কী আছে আমার, নেই। যে ভালোবাসা আপনাকে দেয় তার অধিক আর কিছু দিতে পারে না, বাছারা, সেই ভালোবাসা তোরা পেয়েছিস ; জ্যাঠাইমা চিরদিন থাকবে না, কিন্তু এই কথাটা মনেশ্বরাখিস, মনে রাখিস, মনে রাখিস ।” বলে তার গালে চুমো খেলে। নবীন বললে, “বউরানী, এবার রজবপুরে পৈতৃক ঘরে চলেছি ; এখানকার পালা সাঙ্গ হল ।” কুমু ব্যাকুল হয়ে বললে, “আমি হতভাগিনী এসে তোমাদের এই বিপদ ঘটালুম।” নবীন বললে, “ঠিক তার উলটো । অনেক দিন থেকেই মনটা যাই-যাই করছিল । বেঁধে-সেধে। তৈরি হয়ে ছিলুম, এমন সময় তুমি এলে আমাদের ঘরে । ঘরের আশ খুব করেই মিটেছিল, কিন্তু বিধাতার সাইল না ।” - সেদিন মধুসূদন ফিরে গিয়ে তুমুল একটা বিপ্লব বাধিয়েছিল তা বোঝা গেল । নবীন যাই বলুক, কুমুই যে ওদের সংসারের সমস্ত ওলটপালট করে দিয়েছে মোতির মা'র তাতে সন্দেহ নেই, আর সেই অপরাধ সে সহজে ক্ষমা করতে চায় না। তার মত এই যে, এখনো কুমুর সেখানে যাওয়া উচিত মাথা হেঁট করে, তার পরে যত লাঞ্ছনাই হােক সেটা মেনে নেওয়া চাই। গলা বেশ একটু কঠিন করেই জিজ্ঞাসা করলে, “তুমি কি শ্বশুরবাড়ি একেবারেই যাবে না ঠিক করেছ ?” কুমু তার উত্তরে শক্ত করেই বললে, “না, যাব না ।” মোতির মা জিজ্ঞাসা করলে, “তা হলে তোমার গতি কোথায় ?” কুমু বললে, “মন্ত এই পৃথিবী, এর মধ্যে কোনো-এক জায়গায় আমারও একটুখানি ঠাই হতে পারবে । জীবনে অনেক যায় খসে, তবুও কিছু বাকি থাকে ৷” কুমু বুঝতে পারছিল, মোতির মা'র মন ওর কাছ থেকে অনেকখানি সরে এসেছে। নবীনকে জিজ্ঞাসা করলে, “ঠাকুরপো, তা হলে কী করবে এখন ?” “নদীর ধারে কিছু জমি আছে তার থেকে মোটা ভােতও জুটবে, কিছু হাওয়া খাওয়াও চলবে ।” মোতির মা উন্মার সঙ্গেই বললে, “ওগো মশায়, না, সেজন্যে তোমাকে ভাবতে হবে না । ঐ মির্জাপুরের অন্নজলে দাবি রাখি, সে কেউ কাড়তে পারবে না । আমরা তো এত বেশি সম্মানী লোক নই, বড়েঠাকুর তাড়া দিলেই অমনি বিবাগী হয়ে চলে যাব। তিনিই আবার আজ বাদে কাল ফিরিয়ে ডাকবেন, তখন ফিরেও আসব, ইতিমধ্যে সবুর সইবে, এই বলে রাখলুম।” নবীন একটু ক্ষুন্ন হয়ে বললে, “সে কথা জানি মেজেবিউ, কিন্তু তা নিয়ে বড়াই করি নে। পুনর্জন্ম যদি থাকে। তবে সম্মানী হয়েই যেন জন্মাই, তাতে অন্নজলের যদি টানাটানি ঘটে সেও স্বীকার ।” বস্তুত নবীন অনেকবারই দাদার আশ্রয় ছেড়ে গ্রামে চাষবাসের সংকল্প করেছে। মোতির মা মুখে তর্জনগর্জন করেছে, কাজের বেলায় কিছুতেই সহজে নড়তে চায় নি, নবীনকে বারে বারে আটকে