পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৭০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যোগাযোগ 8GS রেখেছে। সে জানে ভাশুরের উপর তার সম্পূর্ণ দাবি আছে। ভাশুর তো শ্বশুরের স্থানীয়। তার মতে ভাশুর অন্যায় করতে পারে। কিন্তু তাকে অপমান বলা চলে না। কুমুর প্রতি কুমুর স্বামীর ব্যবহার যেমনই হােক তাই বলে কুমু স্বামীর ঘর অস্বীকার করতে পারে, এ কথা মেতির মা'র কাছে নিতান্ত সৃষ্টিছাড়া । খবর এল ডাক্তার এসেছে। কুমু বললে, “একটু অপেক্ষা করো, শুনে আসি ডাক্তার কী বলে ।” ডাক্তার কুমুকে বলে গেল, নাড়ি আরো খারাপ, রাত্তিরে ঘুম কমেছে, বোধ হয় রোগী ঠিক বিশ্রাম পাচ্ছে না । অতিথিদের কাছে কুমু ফিরে যাচ্ছিল, এমন সময় কালু এসে বললে, “একটা কথা না বলে থাকতে পারছি নে, জাল বড়ো জটিল হয়ে এসেছে, তুমি যদি এই সময়ে শ্বশুরবাড়ি ফিরে না যাও, বিপদ আরো ঘনিয়ে ধরবে । আমি তো কোনো উপায় ভেবে পাচ্ছি নে ৷” কুমুচুপ করে দাড়িয়ে রইল। কালু বললে, “তোমার স্বামীর ওখান থেকে তাগিদ এসেছে, সেটা অগ্রাহ্য করবার শক্তি কি আমাদের আছে ? আমরা যে একেবারে তার মুঠোর মধ্যে ।” কুমুবারান্দায় রেলিং চেপে ধরে বললে, “আমি কিছুই বুঝতে পারছি নে কালুদা । প্রাণ ইপিয়ে ওঠে, মনে হয় মরণ ছাড়া কোনো রাস্তাই আমার খোলা নেই।” এই বলে কুমু দ্রুতপদে চলে গেল । দাদার ঘরে যখন কুমু ছিল, সেই অবকাশে ক্ষেমপিসির সঙ্গে মোতির মা'র কিছু কথাবার্তা হয়ে গেছে। নানারকম লক্ষণ মিলিয়ে দুজনেরই মনে সন্দেহ হয়েছে কুমু গর্ভিণী । মেতির মা খুশি হয়ে উঠল, মনে মনে বললে, মা কালী করুন তাই যেন হয় । এইবার জব্দ ! মানিনী শ্বশুরবাড়িকে অবজ্ঞা করতে চান, কিন্তু এ যে নাড়িতে গ্ৰন্থি লাগল, শুধু তো আঁচলে আঁচলে নয়, পালাবে কেমন করে ! কুমুকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে মোতির মা তার সন্দেহের কথাটা বললে। কুমুর মুখ বিবৰ্ণ হয়ে গেল। সে হাত মুঠো করে বললে, “না না, এ কখনোই হতে পারে না, কিছুতেই না ।” মোতির মা বিরক্ত হয়েই বললে, “কেন হতে পারবে না ভাই ? তুমি যতবড়ো ঘরেরই মেয়ে হও-না কেন, তোমার বেলাতেই তো সংসারের নিয়ম উলটে যাবে না। তুমি ঘোষালদের ঘরের বউ তো, মৃত্যুবংশের ইষ্টদেবতা কি তােমাকে সহজে চুটি দেবেন ? পালাবার পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছেন " স্বামীর সঙ্গে কুমুর অল্পকালের পরিচয় দিনে দিনে ভিতরে ভিতরে কী রকম যে বিকৃত মূর্তি ধরেছে গর্ভের আশঙ্কায় ওর মনে সেটা খুব স্পষ্ট হয়ে উঠল। মানুষে মানুষে যে ভেদটা সব চেয়ে দুরতিক্রমণীয়, তার উপাদানগুলো অনেক সময়ে খুব সূক্ষ্ম। ভাষায়, ভঙ্গিতে, ব্যবহারের ছোটাে ছোটাে ইশারায়, যখন কিছুই করছে না। তখনকার অনভিব্যক্ত ইঙ্গিতে, গলার সুরে, রুচিতে, রীতিতে, জীবনযাত্রার আদর্শে, ভেদের লক্ষণগুলি আভাসে ছড়িয়ে থাকে। মধুসূদনের মধ্যে এমন কিছু আছে যা কুমুকে কেবল যে আঘাত করেছে তা নয়, ওকে গভীর লজ্জা দিয়েছে। ওর মনে হয়েছে সেটা যেন অশ্ৰীল। মধুসূদন তার জীবনের আরম্ভে একদিন দুঃসহভাবেই গরিব ছিল, সেইজন্যে পয়সার মাহাত্ম্য সম্বন্ধে সে কথায় কথায় যে মত ব্যক্ত করত সেই গর্বোক্তির মধ্যে তার রক্তগত দারিদ্র্যের একটা হীনতা ছিল। এই পয়সা-পূজার কথা মধুসূদন বার বার তুলত কুমুর পিতৃকুলকে খোটা দেবার জন্যেই। ওর সেই স্বাভাবিক ইত্যরতায়, ভাষার কর্কশতায়, দাম্ভিক অসৌজন্যে, সবসুদ্ধ মধুসূদনের দেহমানের, ওর সংসারের আন্তরিক অশোভনতায় প্রত্যহই কুমুর সমস্ত শরীরমনকে সংকুচিত করে তুলেছে। যতই এগুলোকে দৃষ্টি থেকে চিন্তা থেকে সরিয়ে ফেলতে চেষ্টা করেছে, ততই এরা বিপুল আবর্জনার মতো চারিদিকে জমে উঠেছে। আপন মনের ঘূণার ভাবের সঙ্গে কুমু আপনিই প্ৰাণপণে লড়াই করে এসেছে। স্বামীপূজার কর্তব্যতার সম্বন্ধে সংস্কারটাকে বিশুদ্ধ রাখবার জন্যে। ওর চেষ্টার অন্ত ছিল না, কিন্তু কতবড়ো হার হয়েছে তা এর আগে এমন করে বোঝে নি। মধুসূদনের সঙ্গে ওর রক্তমাংসের বন্ধন অবিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, তার বীভৎসতা ওকে বিষম পীড়া দিলে। কুমু অত্যন্ত উদবিগ্নমুখে মেতির মাকে জিজ্ঞাসা করলে, “কী করে তুমি নিশ্চয় জানলে ?”