পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৯৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শেষের কবিতা 8ዒ6 Gł আলাপের আরম্ভ অতীতের ভগ্নাবশেষ থেকে এবার ফিরে আসা যাক বর্তমানের নতুন সৃষ্টির ক্ষেত্রে। লাবণ্য পড়বার ঘরে অমিতকে বসিয়ে রেখে যোগমায়াকে খবর দিতে গেল । সে ঘরে অমিত বসল। যেন পদ্মের মাঝখানটাতে ভ্ৰমরের মতো । চারি দিকে চায়, সকল জিনিস থেকেই কিসের ছোওয়া লাগে, ওর মনটাকে দেয়। উদাস করে । শেলফে, পড়বার টেবিলে, ইংরেজি সাহিত্যের বই দেখলে ; সে বইগুলো যেন বেঁচে উঠেছে। সব লাবণ্যর পড়া বই, তার আঙুলে পাতা –ওলটানো, তার দিনরাত্রির ভাবনা-লাগা, তার উৎসুক দৃষ্টির পথ -চলা, তার অন্যমনস্ক দিনে কোলের উপর পড়ে-থাকা বই। চমকে উঠল যখন টেবিলে দেখতে পেলে ইংরেজ কবি ডন-এর কাব্যসংগ্ৰহ। অকসফোর্ডে থাকতে ডন এবং তার সময়কার কবিদের গীতিকাব্য ছিল অমিতার প্রধান আলোচ্য, এইখানে এই কাব্যের উপর । দৈবাৎ দুজনের মন এক জায়গায় এসে পরস্পরকে স্পর্শ করল । এতদিনকার নিরুৎসুক দিনরাত্রির দাগ লেগে অমিতার জীবনটা ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল যেন মাস্টারের হাতে ইস্কুলের প্রতি বছরে পড়ানো একটা টিলে মলাটের টেক্সট বুক । আগামী দিনটার জন্য কোনো কৌতুহল ছিল না, আর বর্তমান দিনটাকে পুরো মন দিয়ে অভ্যর্থনা করা ওর পক্ষে ছিল অনাবশ্যক । এখন সে এইমাত্র এসে পীেছল একটা নতুন গ্রহে ; এখানে বস্তুর ভার কম ; পা মাটি ছাড়িয়ে যেন উপর দিয়ে চলে ; প্রতি মুহুর্ত ব্যগ্র হয়ে অভাবনীয়ের দিকে এগোতে থাকে ; গায়ে হাওয়া লাগে আর সমস্ত শরীরটা যেন বঁাশি হয়ে উঠতে ইচ্ছে করে ; আকাশের আলো রক্তের মধ্যে প্রবেশ করে আর ওর অন্তরে অন্তরে যে উত্তেজনার সঞ্চার হয় সেটা গাছের সর্বাঙ্গপ্রবাহিত রসের মধ্যে ফুল ফোটাবার উত্তেজনার মতো । মনের উপর থেকে কতদিনের ধুলো-পড়া পর্দা উঠে গেল, সামান্য জিনিসের থেকে ফুটে উঠছে অসামান্যতা। তাই যোগমায়া যখন ধীরে ধীরে ঘরে এসে প্রবেশ করলেন, সেই অতি সহজ ব্যাপারেও আজ অমিতকে বিস্ময় লাগল । সে মনে মনে বললে, “আহা, এ তো আগমন নয়, এ যে আবির্ভাব ।” চল্লিশের কাছাকাছি তার বয়স, কিন্তু বয়সে তাকে শিথিল করে নি, কেবল তাকে গভীর শুভ্রতা দিয়েছে। গীেরবর্ণ মুখ টস টস করছে। বৈধব্যরীতিতে চুল ছাঁটা ; মাতৃভাবে পূর্ণ প্রসন্ন চােখ ; হাসিটি স্নিগ্ধ। মোটা থান চাদরে মাথা বেষ্টন করে সমস্ত দেহ সংবৃত । পায়ে জুতো নেই, দুটি পা নির্মল সুন্দর । অমিত র্তার পায়ে হাত দিয়ে যখন প্ৰণাম করলে ওর শিরে শিরো যেন দেবীর প্রসাদের ধারা বয়ৈ গেল । প্রথম-পরিচয়ের পর যোগমায়া বললেন, “তোমার কাক অমরেশ ছিলেন আমাদের জেলার সব চেয়ে বড়ো উকিল । একবার এক সর্বনেশে মকদ্দমায় আমরা। ফতুর হতে বসেছিলুম, তিনি আমাদের বঁচিয়ে দিয়েছেন । আমাকে ডাকতেন বিউদিদি বলে ।” অমিত বললে, “আমি তার অযোগ্য ভাইপো । কাকা লোকসান বাঁচিয়েছেন, আমি লোকসান ঘটিয়েছি । আপনি ছিলেন তার লাভের বউদিদি, আমার হবেন লোকসানের মাসিমা ।” যোগমায়া জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার মা আছেন ?” অমিত বললে, “ছিলেন । মাসি থাকাও খুব উচিত ছিল ।” “মাসির জন্যে খেদ কেন বাবা ।” “ভেবে দেখুন-না, আজ যদি ভাঙতুম মায়ের গাড়ি, বকুনির অন্ত থাকত না ; বলতেন এটা বাদরামি । গাড়িটা যদি মাসির হয় তিনি আমার অপটুতা দেখে হাসেন, মনে মনে বলেন ছেলেমানুষি।” যোগমায়া হেসে বললেন, “তা হলে নাহয় গাড়িখানা মাসিরই হল ।” অমিত লাফিয়ে উঠে যোগমায়ার পায়ের ধুলো নিয়ে বললে, “এইজন্যেই তো পূর্বজন্মের কর্মফল (VS