পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৩৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Gł Vé রবীন্দ্র রচনাবলী সময়ের মাঝখানটাতে জলপ্রপাত বা কমলালেবুর সন্ধানে কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। সেইজন্যে বিকেলে সাড়ে-চারটে বেলায় চা-পান-সভার পূর্বে এ বাড়িতে দৈহিক মানসিক কোনোপ্রকার তৃষ্ণানিবারণের সৌজন্যসম্মত সুযোগ অমিতার ছিল না। এই সময়টা কোনোমতে কাটিয়ে কাপড় ছেড়ে যথানির্দিষ্ট সময়ে এখানে সে আসত। আজ হােটেল থেকে বেরোবার আগেই কলকাতা থেকে এসেছে তার আংটি । কেমন করে সে সেই আংটি লাবণ্যকে পরাবে তার সমস্ত অনুষ্ঠানটা সে বসে বসে কল্পনা করেছে। আজ হল ওর একটা বিশেষ দিন । এ দিনকে দেউড়িতে বসিয়ে রাখা চলবে না । আজ সব কাজ বন্ধ করা চাই। মনে মনে ঠিক করে রেখেছে, লাবণ্য যেখানে পড়াচ্ছে সেইখানে গিয়ে বলবে- “একদিন হাতিতে চড়ে বাদশা এসেছিল, কিন্তু তোরণ ছোটাে, পাছে মাথা হেঁট করতে হয় তাই সে ফিরে গেছে, নতুন-তৈরি প্রাসাদে প্রবেশ করে নি। আজ এসেছে আমাদের একটি মহাদিন, কিন্তু তোমার অবকাশের তোরণটা তুমি খাটাে করে রেখেছ— সেটাকে ভাঙো, রাজা মাথা তুলেই তোমার ঘরে প্রবেশ করুন।” অমিত এ কথাও মনে করে এসেছিল যে ওকে বলবে, “ঠিক সময়টাতে আসাকেই বলে। পাঙ্কচুয়ালিটি ; কিন্তু ঘড়ির সময় ঠিক সময় নয়, ঘড়ি সময়ের নম্বর জানে, তার মূল্য জানবে কী করে ।” মতো । অমিত ঘড়ি দেখলে না, পাছে ঘড়িটা তার অভদ্র ইশারায় আকাশের প্রতিবাদ করে, যেমন বহুদিনের জ্বোরো রোগীর মা ছেলের গা একটু ঠাণ্ডা দেখে আর থার্মমিটার মিলিয়ে দেখতে সাহস করে না। আজ অমিত এসেছিল নির্দিষ্ট সময়ের যথেষ্ট আগে । কারণ, দুরাশা নির্লজ্জ । বারান্দায় যে কোণটায় বসে লাবণ্য তার ছাত্রীকে পড়ায়, রাস্তা দিয়ে আসতে সেটা চোখে পড়ে। আজ দেখলে সে জায়গাটা খালি । মন আনন্দে লাফিয়ে উঠল । এতক্ষণ পরে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলে। এখনো তিনটে বেজে বিশ মিনিট । সেদিন ও লাবণ্যকে বলেছিল, নিয়মপালনটা মানুষের, অনিয়মটা দেবতার ; মর্তে আমরা নিয়মের সাধনা করি স্বর্গে অনিয়ম-অমৃতে অধিকার পাব বলেই। সেই স্বৰ্গ মাঝে মাঝে মার্তেই দেখা দেয়, তখন নিয়ম ভেঙে তাকে সেলাম করে নিতে হয় । আশা হল, লাবণ্য নিয়ম-ভাঙার গৌরব বুঝেছে বা ; লাবণ্যর মনের মধ্যে হঠাৎ আজ বুঝি কেমন করে বিশেষ দিনের স্পর্শ লেগেছে, সাধারণ দিনের বেড়া গেছে ভেঙে । নিকটে এসে দেখে, যোগমায়া তার ঘরের বাইরে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে, আর সিসি তার মুখের সিগারেট কেটির মুখের সিগারেট থেকে জ্বালিয়ে নিচ্ছে। অসম্মান যে ইচ্ছাকৃত তা বুঝতে বাকি রইল না। ট্যাবি-কুকুরটা তার প্রথম-মৈত্রীর উচ্ছাসে বাধা পেয়ে কেটির পায়ের কাছে শুয়ে একটু নিদ্রার চেষ্টা করছিল । অমিতর আগমনে তাকে সম্বর্ধনা করবার জন্যে আবার অসংযত হয়ে উঠল ; সিসি আবার তাকে শাসনের দ্বারা বুঝিয়ে দিলে যে, এই সদভাবপ্রকাশের প্রণালীটা এখানে সমাদৃত হবে না। দুই সখীর প্রতি দৃকপাতমাত্র না করে “মাসি” বলে দূর থেকে ডেকেই অমিত যোগমায়ার পায়ের কাছে পড়ে তীর পায়ের ধুলো নিলে । এ সময়ে এমন করে প্রণাম করা তার প্রথার মধ্যে ছিল না । জিজ্ঞাসা করলে, “মাসিম, লাবণ্য কোথায় ।” “কী জানি বাছা, ঘরের মধ্যে কোথায় আছে।” “এখনো তো তার পড়বার সময় শেষ হয় নি ।” “বোধ হয় ঐরা আসতে ছুটি নিয়ে ঘরে গেছে।” “চলো, একবার দেখে আসি সে কী করছে।” যোগমায়াকে নিয়ে অমিত ঘরে গেল। সম্মুখে যে আর-কোনো সজীব পদার্থ আছে সেটা সে সম্পূর্ণই অস্বীকার করলে। . সিসি একটু চেচিয়েই বলে উঠল, “অপমান ! চলো কোটি, ঘরে যাই ।” কেটিও কম জ্বলে নি । কিন্তু শেষ পর্যন্ত না দেখে সে যেতে চায় না। সিসি বললে, “কোনাে ফল হবে না।”