পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৩৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শেষের কবিতা (łSS ܣܠܼ মুক্তি একটি ছোটাে চিঠি এল লাবণ্যর হাতে, শোভনলালের লেখা : শিলঙে কাল রাত্রে এসেছি। যদি দেখা করতে অনুমতি দাও। তবে দেখতে যাব । না। যদি দাও কালই ফিরব । তোমার কাছে শান্তি পেয়েছি, কিন্তু কবে কী অপরাধ করেছি আজ পর্যন্ত স্পষ্ট করে বুঝতে পারি নি। আজ এসেছি তোমার কাছে সেই কথাটি শোনবার জন্যে, নইলে মনে শান্তি পাই নে । ভয় কোরো না । আমার আর কোনো প্রার্থনা নেই । লাবণ্যর চােখ জলে ভরে এল। মুছে ফেললে । চুপ করে বসে ফিরে তাকিয়ে রইল নিজের অতীতের দিকে । যে অঙ্কুরটা বড়ো হয়ে উঠতে পারত অথচ যেটাকে চেপে দিয়েছে, বাড়তে দেয় নি, তার সেই কাচিবেলাকার করুণ ভীরুতা ওর মনে এল। এতদিনে সে ওর সমস্ত জীবনকে অধিকার করে তাকে সফল করতে পারত। কিন্তু সেদিন ওর ছিল জ্ঞানের গর্ব, বিদ্যার একনিষ্ঠ সাধনা, উদ্ধত স্বাতন্ত্র্যবোধ । সেদিন আপনি বাপের মুগ্ধতা দেখে ভালোবাসাকে দুর্বলতা বলে মনে মনে ধিক্কার দিয়েছে। ভালোবাসা আজ তার শোধ নিলে, অভিমান হল ধূলিসাৎ ৷ সেদিন যা সহজে হতে পারত নিশ্বাসের মতো, সরল হাসির মতো, আজ তা কঠিন হয়ে উঠল । সেদিনকার জীবনের সেই অতিথিকে দু। হাত বাড়িয়ে গ্রহণ করতে আজ বাধা পড়ে, তাকে ত্যাগ করতেও বুক ফেটে যায় । মনে পড়ল অপমানিত শোভনলালের সেই কুষ্ঠিত ব্যথিত মূর্তি। তার পরে কতদিন গেছে, যুবকের সেই প্রত্যাখ্যাত ভালোবাসা এতদিন কোন অমৃতে বেঁচে রইল। আপনারই আন্তরিক মাহাষ্ম্যে। . লাবণ্য চিঠিতে লিখলে ; তুমি আমার সকলের বড়ো বন্ধু । এ বন্ধুত্বের পুরো দাম দিতে পারি। এমন ধন আজ আমার হাতে নেই। তুমি কোনোদিন দাম চাও নি ; আজও, তোমার যা দেবার জিনিস তাই দিতে এসেছ কিছুই দাবি না করে। চাই নে বলে ফিরিয়ে দিতে পারি। এমন শক্তি নেই আমার, এমন অহংকারও নেই । চিঠিটা লিখে পাঠিয়ে দিয়েছে এমন সময় অমিত এসে বললে, “বন্যা, চলো আজ দুজনে একবার বেড়িয়ে আসি গে।” অমিত ভয়ে ভয়েই বলেছিল ; ভেবেছিল, লাবণ্য আজ হয়তো যেতে রাজি হবে না । লাবণ্য সহজেই বললে, “চলো ।” দুজনে বেরোল। অমিত কিন্তু দ্বিধার সঙ্গেই লাবণ্যর হাতটিকে হাতের মধ্যে নেবার চেষ্টা করলে । লাবণ্য একটুও বাধা না দিয়ে হাত ধরতে দিলে। অমিত হাতটি একটু জোরে চেপে ধরলে, তাতেই মনের কথা যেটুকু ব্যক্ত হয় তার বেশি কিছু মুখে এল না ! চলতে চলতে সেদিনকার সেই জায়গাতে এল যেখানে বনের মধ্যে হঠাৎ একটুখানি ফাঁক । একটি তরুশূন্য পাহাড়ের শিখরের উপর সূর্য আপনার শেষ স্পর্শ ঠেকিয়ে নেমে গেল। অতি সুকুমার সবুজের আভা আস্তে আন্তে সুকোমল নীলে গেল মিলিয়ে। দুজনে থেমে সেই দিকে মুখ করে দাড়িয়ে রইল। লাবণ্য আস্তে আন্তে বললে, “একদিন একজনকে যে আংটি পরিয়েছিলে, আমাকে দিয়ে আজ সে আংটি খোলালে কেন ।” অমিত ব্যথিত হয়ে বললে, “তোমাকে সব কথা বোঝােব কেমন করে বন্যা । সেদিন যাকে আংটি পরিয়েছিলুম, আর যে আজ সেটা খুলে দিলে, তারা দুজনে কি একই মানুষ ।” লাবণ্য বললে, “তাদের মধ্যে একজন সৃষ্টিকর্তার আদরে তৈরি, আর একজন তোমার অনাদরে গড়া।” অমিত বললে, “কথাটা সম্পূর্ণ ঠিক নয়। যে আঘাতে আজকের কোিট তৈরি, তার দায়িত্ব কেবল আমার একলার নয় ।”