পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৮১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

G2WgSR রবীন্দ্র-রচনাবলী প্রত্যাবর্তন করিবার সময় কিঞ্চিৎ অতিরিক্ত স্পর্ধার সহিত আস্ফালন করাও অস্বাভাবিক নহে- বুক ফুলাইয়া সর্বসাধারণকে বলিতে ইচ্ছা করে, ইহা আমাদের হার নহে, জিত । আমাদের বঙ্গসমাজের এইরূপ উলটারথের দিনে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কৃষ্ণচরিত্র রচিত হয়। যখন বড়ো-ছোটাে অনেকে মিলিয়া জনতার স্বরে স্বর মিলাইয়া গোলে হরিবোল দিতেছিলেন তখন প্রতিভার কণ্ঠে একটা নূতন সুর বাজিয়া উঠিল— বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কৃষ্ণচরিত্র গোলে হরিবোল নহে। ইহাতে সর্বসাধারণের সমর্থন নাই, সর্বসাধারণের প্রতি অনুশাসন আছে। যে সময়ে ‘কৃষ্ণচরিত্র রচিত হইয়াছে সেই সময়ের গতি এবং বঙ্কিমের চতুর্দিকবতী অনুবর্তিগণের ভাবভঙ্গি বিচার করিয়া দেখিলে এই “কৃষ্ণচরিত্র’ গ্রন্থে প্রতিভার একটি প্রবল স্বাধীন বল অনুভব করা | সেই বলটি আমাদের একটি স্থায়ী লাভ । সেই বলটি বাঙালির পরম আবশ্যক। সেই বল স্থানে স্থানে ন্যায় এবং শিষ্টতার সীমা লঙঘন করিয়াছে তথাপি তাহা আমাদের ন্যায় হীনবীৰ্য ভীরুদের পক্ষে একটি অভয় আশ্রয়দণ্ড । যখন আমাদের দেশের শিক্ষিত লোকেরাও আত্মবিস্মৃত হইয়া অন্ধভাবে শাস্ত্রের জয়ঘোষণা করিতেছিলেন তখন বঙ্কিমচন্দ্ৰ বীরদপসহকারে ‘কৃষ্ণচরিত্র গ্রন্থে স্বাধীন মনুষ্যবৃদ্ধির জয়পতাকা উডউীন করিয়াছেন । তিনি শাস্ত্রকে ঐতিহাসিক যুক্তিদ্বারা তন্নতন্নরূপে পরীক্ষা করিয়াছেন এবং চিরপ্রচলিত বিশ্বাসগুলিকেও বিচারের অধীনে আনয়নপূর্বক অপমানিত বুদ্ধিবৃত্তিকে পুনশ্চ তাহার গৌরবের সিংহাসনে রাজপদে অভিষিক্ত করিয়া দিয়াছেন । আমাদের মতে 'কৃষ্ণচরিত্র’ গ্রন্থের নায়ক কৃষ্ণ নহেন, তাহার প্রধান অধিনায়ক, স্বাধীন বুদ্ধি, সচেষ্ট চিত্তবৃত্তি । প্রথমত বঙ্কিম বুঝাইয়াছেন, জড়ভাবে শাস্ত্রের অথবা লোকাচারের অনুবতী হইয়া আমরা পূজা করিব না, সতর্কতার সহিত আমাদের মনের উচ্চতম আদর্শের অনুবতী হইয়া পূজা করিব । তাহার পরে দেখাইয়াছেন, যাহা শাস্ত্র তাঁহাই বিশ্বাস্য নহে, যাহা বিশ্বাস্য তাঁহাই শাস্ত্র । এই মূল ভাবটিই 'কৃষ্ণচরিত্র গ্রন্থের ভিতরকার অধ্যাত্মশক্তি, ইহাই সমস্ত গ্রন্থটিকে মহিমান্বিত করিয়া রাখিয়াছে। বর্তমান গ্রন্থে কৃষ্ণচরিত্রের শ্রেষ্ঠতা এবং ঐতিহাসিকতা প্রমাণের বিষয় । গ্রন্থের প্রথমাংশে লেখক ইতিহাস আলোচনা করিয়াছেন । কৃষ্ণচরিত্রের রীতিমত ইতিহাস-সমালোচনা এই প্রথম । ইতিপূর্বে কেহ ইহার সূত্রপাত করিয়া যায় নাই, এইজন্য ভাঙিবার এবং গড়িবার ভার উভয়ই বঙ্কিমকে লইতে হইয়াছে। কোনটা ইতিহাস তাহা স্থির করিবার পূর্বে কোনটা ইতিহাস নহে তাহা নির্ণয় করা বিপুল পরিশ্রমের ও বিচক্ষণতার কাজ । আমাদের বিবেচনায় বর্তমান গ্রন্থে বঙ্কিম সেই ভাঙিবার কাজ অনেকটা পরিমাণে শেষ করিয়াছেনগড়িবার কাজে ভালো করিয়া হস্তক্ষেপ করিবার অবসর পান নাই। মহাভারতকেই বঙ্কিম প্রধানত আশ্রয় করিয়াছেন । কিন্তু তিনি নিঃসংশয়ে প্রমাণ করিয়াছেন যে, মহাভারতের মধ্যে বিস্তর প্রক্ষিপ্ত অংশ আছে। অথচ ঠিক কোনটুকু যে মূল মহাভারত তাহা তিনি স্থাপনা করিয়া যান নাই। তিনি স্বয়ং বলিয়াছেন ‘প্রচলিত মহাভারত আদিম বৈয়াসিকী সংহিতা নহে। ইহা বৈশম্পায়ন-সংহিতা বলিয়া পরিচিত, কিন্তু আমরা প্রকৃত বৈশম্পায়ন-সংহিতা পাইয়াছি কি না তাহা সন্দেহ। তার পরে প্রমাণ করিয়াছি যে, ইহার প্রায় তিন ভাগ প্ৰক্ষিপ্ত ।” । বঙ্কিম মহাভারতের তিনটি স্তর আবিষ্কার করিয়াছেন । প্রথম স্তরের রচনা উদার ও উচ্চকবিত্বপূৰ্ণ ; দ্বিতীয় স্তরের রচনা অনুদার এবং কাব্যাংশে কিছু বিকৃতিপ্ৰাপ্ত এবং তৃতীয় স্তর বহুকালের বহুবিধ এ কথা পাঠকদিগকে বলা বাহুল্য যে, কাব্যাংশের উৎকর্ষ ও অপকর্ষ বিচার করিয়া স্তরনির্ণয় করা নিতম্ভই আনুমানিক । রুচিভেদে কবিত্ব ভিন্নলোকের নিকট ভিন্নরূপে প্রতীয়মান হয়। আবার, একই কবির রচনার ভিন্ন ভিন্ন অংশের কবিত্ব হিসাবে আকাশ-পাতাল তফাত হয় এমন দৃষ্টান্ত দুর্লভ নহে ।